গাইবান্ধার সাঘাটায় ভিন্ন চাষাবাদের পদ্ধতি

আমির হোসেন

দরিদ্র পরিবারে জন্ম। ছোটবেলা অভাবের কারণে দুই বেলা খাবার জুটত না। টাকার অভাবে পড়ালেখা করতেও পারেননি। সংসার চালাতে শুরু করেন দিনমজুরি। কিন্তু দিনমজুরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। একপর্যায়ে শুরু করেন নতুন জাতের সবজি চাষ। নিজের উদ্ভাবন করা কীটনাশকে ফসল চাষ এবং একই জমিতে ১০ ধরনের ফসল উৎপাদন করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। শুধু ফসল চাষেই দক্ষ হয়ে ওঠেননি তিনি। শ্রম, অধ্যবসায় ও সৃজনশীলতা কৃষিতে এনে দিয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। একসময়ের শূন্য হাতে কৃষিকাজ শুরু করে তিনি আজ কোটি টাকার মালিক। 

অজপাড়াগাঁয়ের এই সফল কৃষকের নাম আমির হোসেন (৫২)। বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পুটিমারি গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণি পাস। ১১৫ টাকার অভাবে বাবা বই কিনে দিতে পারেননি। তাই ভর্তি হতে পারেননি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। অভাবের সংসার। বাবাকে সহায়তা করতে ছোটবেলা থেকেই দিনমজুরের কাজ করেন। ১৯৮৮ সালে বিয়ে করেন। বাবার সংসারে আট বছর কেটে যায়। ১৯৯৬ সালে বাবা তাঁকে পৃথক করে দেন। তখন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তিন শতক বসতভিটা ও পাঁচ শতক আবাদি জমি পান। সামান্য জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে বাজারে কাঁচা তরিতরকারি বিক্রি শুরু করেন। এ ব্যবসাতেও হিমশিম খেতে থাকেন। কিছু একটা করার কথা ভাবেন। ওই ভাবনা থেকেই সবজিসহ নানা ধরনের ফসল চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। তাঁর ফসল চাষের পদ্ধতিই ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। মনে হয় তাঁর হাতে যেন জাদু ছিল। তিনি যেই ফসলই চাষ করতেন, তার ফলন হতো প্রচুর। ভালো মানের হয়, বাজারে বিক্রি করে লাভ পেতেন বেশ।

শুরুর কথা

১৯৯৬ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১০০টি পেঁপের চারা কেনেন। সেগুলো পাঁচ শতক জমিতে লাগান। সাথি ফসল হিসেবে লাগান আদা। ছয় মাস পর ১৩ হাজার টাকার পেঁপে ও আদা বিক্রি করেন।

প্রথমবারের আয় ও অবশিষ্ট টাকা সংগ্রহ করে ২৩ শতক জমি কেনেন। এই জমিতেও পেঁপে ও সাথি ফসল আদা চাষ করেন। পরের বছর ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা লাভ করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে আমির কৃষিকাজে সাফল্য অর্জন করতে থাকেন। পাঁচ শতক জমি থেকে এখন তিনি ১৪ বিঘা জমির মালিক।

একই জমিতে এত ফসল

আমির হোসেনের ১৪ বিঘা জমির মধ্যে ৩ বিঘা নিয়ে বসতভিটা গড়ে তুলেছেন। আর ১১ বিঘায় কৃষিকাজ করেন। প্রায় প্রতিটি জমিতে কমপক্ষে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১০ ধরনের ফসল উৎপাদন করছেন। একই জমিতে আছে উন্নত জাতের আখ। প্রতিটি আখ লম্বা প্রায় ১১ ফুট। ওই জমিতে পেয়ারা ও পেঁপের গাছ। এসব গাছের নিচে লাগিয়েছেন মরিচ, নবরত্ন কচু ও ডাঁটা শাক। আবার মাটির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে হলুদ ও আদা। জমির চারদিকে প্রায় ৫০০টি দেশি কলার গাছ। চারদিকের চারটি আলে দোল খাচ্ছে নেপিয়ার ঘাস। প্রতিটি গাছে পেঁপে ধরেছে। ৬০০টি নবরত্ন জাতের কচুগাছ লাগান। 

ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তি

সাধারণত রোদে আদা ও হলুদ হয় না। এসব উৎপাদনে ছায়া দরকার। এ জন্য জমিতে প্রথমে পেঁপে, পেয়ারা ও আখ রোপণ করেন। তারপর মাটির নিচে আদা ও হলুদ লাগানো হয়। এতে আধা ছায়ার সৃষ্টি হয়ে আদা ও হলুদ উৎপাদন হয়। এ ছাড়া জমি ফাঁকা থাকলে ঘাস হয়। ঘাস পরিচর্যা করতে শ্রমিক খরচ বাড়ে। এ জন্য পেঁপে, পেয়ারা ও আখের ফাঁকে ফাঁকে ডাঁটাশাক ও নবরত্ন কচু লাগান। আদা ও হলুদ বড় হতে হতে শাক ও কচু উঠে যায়। যখন আদা ও হলুদ ওঠে, তখন শাক ও কচু থাকে না। জমির আল দিয়ে মানুষ চলাচল করে। তাই কলাগাছ ও নেপিয়ার ঘাস লাগানো হয়। 

আমির হোসেনের অর্জন

কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আমির হোসেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি কৃষিকাজ করে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন তিনি। বর্তমানে তাঁর বার্ষিক আয় ১৩ লাখ টাকা, ব্যয় ৫ লাখ টাকা। খরচ বাদে আট লাখ টাকা টেকে। 

আমির হোসেন বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে যেসব নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে, আমি সেসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করছি। এর ফলও পেয়েছি। ৯০ শতাংশ জৈব সার ব্যবহার করে সব জমিতেই ৪ থেকে ১০টি পর্যন্ত ফসল ফলাচ্ছি।’

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.