জামালপুরের মজাদার ‘ম্যান্দা’

জামালপুরে একটি উৎসবে ম্যান্দার আয়োজন। ডেক থেকে ভাতের পাতে ম্যান্দা পরিবেশন করা হচ্ছে

বড় কোনো উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রসঙ্গ উঠলেই জামালপুর অঞ্চলে খাবারের তালিকার প্রথমেই থাকে ম্যান্দার নাম। এই খাবারের নাম শুনলেই জামালপুরবাসীর জিবে জল আসে। জামালপুরসহ পাশের গাইবান্ধার কিছু কিছু অঞ্চলেও এই খাবারের প্রচলন রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, শতবছরের বেশি সময় ধরে গ্রাম কিংবা শহরের বড় অনুষ্ঠানগুলোতে ম্যান্দার আয়োজন থাকে। ঐতিহ্যবাহী এই খাবার মিল্লি বা পিঠালি নামেও পরিচিত। ম্যান্দা কিন্তু প্রতিদিনের খাবার নয়। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের চেহলাম, আকিকাসহ বিশেষ অনুষ্ঠানে সাদা ভাতের সঙ্গে এই খাবার পরিবেশন করা হয়। তবে এই খাবারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় জামালপুর শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় ম্যান্দা পাওয়া যায়। 

ম্যান্দা দেখতে অনেকটা হালিমের মতো। তবে ম্যান্দা হালিমের চেয়ে বেশি ঘন ও আঠালো। ম্যান্দা তৈরিতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রধানত গরুর মাংস আর চালের গুঁড়া। তবে আদি ম্যান্দায় মহিষের মাংস দেওয়া হতো। মাংস ও চালের গুঁড়ার সঙ্গে থাকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কাঁচা ও শুকনা মরিচ, জিরাসহ নানারকমের মসলা। অনেকে খাসির মাংসও ব্যবহার করেন। 

অন্যান্য অঞ্চলের মতো জামালপুরের মানুষও ভাত, সবজি, মাছ, মাংস ও ডালে অভ্যস্ত। তবে কোনো বড়িতে যখন ম্যান্দা রান্না হয়, তখন যেন উৎসব লেগে যায়। 

জামালপুর শহরের ম্যান্দার পুরোনো বাবুর্চিদের একজন সুহেল রানা। শহরের উপজেলা পরিষদের পাশে সুহেল রানার একটি রেস্তোরাঁ আছে। ২০ বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুহেল ম্যান্দা রান্না করছেন। বাবা মন্তাজ আলীর কাছ থেকে সুহেল ম্যান্দা রান্না শিখেছেন। 

যেভাবে ম্যান্দা রান্না হয় 

সুহেলের মতে, ম্যান্দা রান্না করা খুব কঠিন নয়। তবে এটা রান্নার জন্য সব কটি উপকরণ হাতের কাছে চাই। প্রথমে মাংসের টুকরাগুলো একটু বড় করে কেটে ভালোভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার একটি হাঁড়িতে মাংসের সঙ্গে নিতে হবে হলুদ, মরিচ, জিরা ভাজা, লবণ, রসুনবাটা ও আদাবাটা। এসব উপকরণ একসঙ্গে শর্ষের তেল বা সয়াবিন তেল দিয়ে ভালোভাবে মেখে আধা ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে মসলা মাখানো মাংস দিয়ে দিন। হাঁড়িতে পরিমাণমতো পানি দিয়ে জাল দিতে থাকুন। এভাবে ৩০ মিনিট সময় চুলায় রাখতে হবে। পানি কিছুটা শুকিয়ে এলে হাঁড়িতে গরম পানি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিতে হবে। 

মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ করার জন্য ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ি ঢেকে রাখতে হবে। মাংস সেদ্ধ হওয়ার সময় হাঁড়িতে যোগ করতে হবে পেঁয়াজকুচি আর গরম মসলার গুঁড়া। এরপর একে একে এলাচি, ধনে, গোলমরিচ, জয়ত্রী ও এলাচিগুঁড়া দিয়ে মাংস ভালোভাবে কষিয়ে নিন। আবার কিছুটা গরম পানি দিয়ে যোগ করতে হবে। এরপর হাঁড়ি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে আবার ৪০ থেকে ৫০ মিনিটের জন্য অপেক্ষা। রান্নার শেষ ধাপে চালের গুঁড়া ঢেলে পাঁচ থেকে সাত মিনিট নাড়াচাড়া করলেই প্রস্তুত হয়ে যাবে মজাদার ম্যান্দা।

কীভাবে এল ম্যান্দা

ঠিক কবে থেকে জামালপুরবাসীর সঙ্গে এই খাবারের সখ্য গড়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, শত বছরের বেশি সময় ধরে জামালপুরবাসী ম্যান্দার ঐতিহ্য লালন করছেন। স্বাধীনতার আগেও গ্রামের বৈঠক ও বিয়ের অনুষ্ঠানে ম্যান্দা পরিবেশন করা হতো। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কারও মৃত্যুর ৪০ দিন পর যে দোয়ার আয়োজন করা হয়, স্থানীয়ভাবে এই অনুষ্ঠানকে জামালপুরে ‘বেপার’ বলে। বেপারসহ আকিকা ও খতনা অনুষ্ঠানেও ম্যান্দার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া জামালপুরবাসী নিজেদের বাড়িতেও ছোট অনুষ্ঠানে ম্যান্দা রান্না করে খেতে পছন্দ করেন। 

যেখানে পাবেন

জামালপুর শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার রেস্তোরাঁগুলোতে বিক্রি করা হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ম্যান্দা। জামালপুর শহরের উপজেলা পরিষদসংলগ্ন হোটেল নূর জাহান, হোটেল ফিরোজ মিয়া, কথাকলি মার্কেট এলাকার হোটেল ভর্তা ভাই, আজাদ ডাক্তার মোড় এলাকার হোটেল খালেকে ম্যান্দা পাওয়া যায়। এ ছাড়া শহরের গেটপার, ফৌজদারি, বাইপাস এলাকার বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানেও ম্যান্দা বিক্রি হয়।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.