জীবনানন্দের জন্মশহরে সোনালি লতার ঝিলিক
বরিশাল নগরের বাংলাবাজার থেকে পশ্চিম দিকে আমতলা মোড় যেতে একটি বাড়ির মূল ফটকে বাগানবিলাসের শরীরে ঠাঁই নিয়েছে পরজীবী একগুচ্ছ সোনালি লতা । ছবি: সংগৃহীত
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মশহর বরিশাল এখন আর তেমন সবুজ নেই। সড়কের পাশে সারি সারি সবুজ গাছ, তার শরীরে জন্মানো পরজীবী উদ্ভিদ—এসবই এখন স্মৃতি। তবু জীবনানন্দের কবিতা যখনই উচ্চারিত হয়, তখনই খাল-নদী, বনবাদাড়ের সবুজে ঘেরা নিসর্গ চোখে ভাসে। নগরায়ণ আর উন্নয়নের দাপটে এই শহর অনেক আগেই রুক্ষ, রসকষহীন হয়ে গেছে। অথচ একদিন এই শহরেই সুন্দরের কবি পরজীবী সোনালি লতার (স্বর্ণলতা) সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন। তাঁর একাধিক কবিতায় সেই সোনালি লতার নাম এসেছে।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় সোনালি লতার কথা বলেছিলেন এভাবে—
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!—…’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পথ চলতে গিয়ে একচিলতে সোনালি লতার আকাশ ছোঁয়ার আকুতি চোখে পড়ে। সেখানেই যেন মূর্ত হয়ে ওঠেন কবি। নগরের দক্ষিণ আলেকান্দা এলাকার বাংলাবাজার সড়ক ধরে আমতলা মোড়ের দিকে যেতেই একটি বাড়ির ফটকের ওপরে বাগানবিলাসের সরু ডালপালা। তার শাখায় শাখায় রঙিন ফুল। তার ওপরেই ঠাঁই নিয়েছে পরজীবী একগুচ্ছ স্বর্ণলতা। শীতের দুপুরের কমলা রোদ তার শরীরে কাঁচা হলুদ মেখে দিয়েছে! শিকড় নেই, পাতা নেই, তবু মাথা উঁচু করে যেন আকাশ ছুঁতে চায় সুতার মতো ছড়িয়ে-জড়িয়ে থাকা লতারা। বাগানবিলাসের উজ্জ্বল ফুলগুলো মিলেমিশে মিতালি করেছে স্বর্ণলতার সঙ্গে। চিকচিকে রোদ এসে তাদের শরীরে মাখামাখি করায় এর উজ্জ্বলতা পথচারীদের যে কারও চোখ ধাঁধায়।
স্বর্ণলতা এই নগরের মানুষের কাছে এখন আর তেমন পরিচিত উদ্ভিদ নয়। এমনকি কংক্রিটের এই শহরে খুব একটা দেখাও যায় না। রাজু রাজ নামের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তাঁর তিন বন্ধুকে নিয়ে ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন। তাঁরা বাড়িটার ফটকে দৃষ্টিনন্দন এই ফুল আর স্বর্ণলতার গভীর মিতালির সৌন্দর্য দেখছিলেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তাঁদের সবার কাছেই লতাটি অচেনা।
জিজ্ঞাসা করতেই রাজুর উজ্জ্বল চোখ ইশারা করছিল, ‘দেখুন তো কী সুন্দর!’ ফুলটির নাম জানলেও লতাটির নাম জানেন না রাজু ও তাঁর বন্ধুরা। একই সঙ্গে বিস্ময়ের ঘোর তাঁদের চোখে। একটি গাছে এভাবে ফুল আর ভিন্ন জাতের লতার মিতালি কী করে সম্ভব! রাজুদের বিস্ময়ের মধ্যেই ব্যস্ত সড়কে খালি রিকশা নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ এক রিকশাচালক এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘কত দিন পর শূন্যলতা দেখলাম!’ ‘শূন্যলতা’! এ আবার কী ধরনের উদ্ভিদ? রাজু আর তাঁর বন্ধুদের প্রশ্ন শুনে রিকশাচালক আবুল কালাম বলেন, ‘আপনেরা চিনবেন না। আমরা গ্রামের মানুষ। আগে বনবাদাড়ে, পথের ধারে এই লতা ছিল অহরহ। অন্ধকার রাইতে জোনাকিরা এই লতার শরীরে গেঁথে কী যে সুন্দর আলো দিত!’
দক্ষিণের মানুষের কাছে এই লতা ‘শূন্যলতা’ নামেই বেশি পরিচিত। উদ্ভিদটির দেহ সোনালি রঙের; চিকন লতার মতো। তাই এমন নামকরণ। তবে কোথাও কোথাও এটি ‘আলোকলতা’ নামেও পরিচিত।
শীতকালে লতাটিতে ফোটে ঘণ্টাকার ছোট ছোট ফুল। দুধসাদা রঙের সেই ফুলের ঘ্রাণে ছুটে আসে মৌমাছি। এর ফুল আকৃতিতে অনেক ছোট। গ্রামের শিশুদের কাছে লতাটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল একসময়। এক বর্ষজীবী এই লতার ঔষধি গুণও অনেক। এর রস ক্ষত ও নানা ধরনের ব্যথা উপশমে বেশ কার্যকর বলে সুখ্যাতি আছে। লতাটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘কুসুটা রিফ্লেক্সা’। ভারতীয় উপমহাদেশেই এর আধিক্য। ভারতে এটি ‘অমর বেল’ এবং নেপালে ‘আকাশ বেলি’ নামে পরিচিত।
প্রকৃতিবিষয়ক লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘গাছপালা তরুলতা’ নামে গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সারা বিশ্বে দেড় শতাধিক প্রজাতির স্বর্ণলতা থাকলেও আমাদের দেশে চার প্রজাতির সোনালি লতা পাওয়া যায়।’