প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর সোনাদিয়া দ্বীপজুড়ে এখন শুধু প্লাস্টিক বর্জ্য

কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের সৈকতজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ময়লা পড়ে আছে

কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ১০ হাজার একর আয়তনের ছোট্ট দ্বীপ ‘সোনাদিয়া’। একসময় দ্বীপটিতে মুক্তার চাষ হতো এবং তা সোনার দামে বেচা-বিক্রি হতো বলে দ্বীপের নামকরণ হয়েছে সোনাদিয়া। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোন ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড সোনাদিয়ায় ৩৩৪ পরিবারের লোকসংখ্যা ৮১০।

প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে সমুদ্রসৈকত। একটা সময় সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ ছিল। ছিল গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপের আনাগোনা। প্যারাবনে বিলুপ্ত প্রজাতির চামচ ঠুঁটো (স্যান্ডপাইপার) পাখিসহ শত প্রজাতির পাখির মেলা বসত। এখন তার কিছুই নেই। সৈকতজুড়ে প্লাস্টিকের বর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। আর প্যারাবন উজাড় করে চিংড়িঘের তৈরিও থেমে নেই। দখল ও দূষণে দ্বীপের বিরল প্রজাতির পাখপাখালি, বৃক্ষ ও লতাগুল্ম ধ্বংস হওয়ার পথে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী দ্বীপের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, দ্বীপের পূর্ব পাড়া থেকে পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সৈকত প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরপুর। জোয়ারে ভেসে আসা বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, বোতল, প্লাস্টিকের ক্যান, স্যান্ডেল, পলিথিন ব্যাগ, মাছ ধরার জাল, মেডিকেল বর্জ্যসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য সেখানে। স্থানীয় জেলে জলিল আহমদ (৫৫) বলেন, জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা বেশির ভাগ প্লাস্টিক সৈকতের বালুর নিচে চাপা পড়ছে। কিছু জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে মাছ ও পাখি। গভীর সমুদ্রে দেশি-বিদেশি জাহাজ থেকে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য জোয়ারে ভেসে এই দ্বীপে জমা হচ্ছে। এসব সরানোর কেউ নেই।

সোনাদিয়ার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য একরাম মিয়া বলেন, গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে কয়েক শ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৈকতে ভেসে আসে। মাঝেমধ্যে জোয়ারে ভেসে আসছে প্লাস্টিক পণ্য ও মরা জীবজন্তু। বর্জ্য সরাতে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।

৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দরের নেতৃত্বে একদল পরিবেশবিজ্ঞানী সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শনে যান। তাঁরা পরিবেশ নষ্টের এই ভয়াবহ চিত্র দেখতে পান।

প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সোনাদিয়ার মাটি দূষণের শঙ্কা প্রকাশ করে সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, সৈকতে ভেসে আসা প্লাস্টিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে আবার সাগরে মিশে যাচ্ছে। তাতে সমুদ্রের পানি দূষিত হচ্ছে। এ কারণে প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।  তিন যুগ আগের সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য ইতিমধ্যে ৯০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে।

সোনাদিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট-নেকম। সংস্থার কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ূম বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্যে সৈকতের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে পড়ায় কচ্ছপের ডিম পাড়ার হারও কমে গেছে। অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী এবং পাখপাখালিও হারিয়ে যেতে বসেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ এই দ্বীপে বছরে ১০ হাজারের বেশি ডিম পাড়ত। এখন এক হাজারের বেশি ডিম হয় না। গত বছর সৈকত থেকে ডিম সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় এক হাজার। সৈকতজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে থাকায় গভীর সমুদ্র থেকে ছুটে আসা মা কচ্ছপ ডিম পাড়ার পরিবেশ হারাচ্ছে। তা ছাড়া নির্জন এই দ্বীপে পর্যটকের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং রাতযাপনের ফলে জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান বেলা অবেলাকে বলেন, সোনাদিয়ায় বিশ্বমানের ‘ইকো-ট্যুরিজম পার্ক’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পার্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব মাস্টার প্ল্যানের কাজ চলছে।

বেজার পরিকল্পনামতে, প্রাথমিকভাবে দ্বীপের ৩০ শতাংশ জায়গায় ইকোট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলা হবে। এসব জায়গার মধ্যে ১০টি হোটেল-মোটেল, দুটি গলফ কোর্স ও দুটি টেনিস কোটের বিপরীতে ৫০০ একর এবং শিশুপার্ক, মসজিদ, জাদুঘর, কমিউনিটি সেন্টার, শৈবাল ও মুক্তা চাষসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য রাখা হয়েছে আরও ৫৫১ একর জমি। বাকি ৩০ একর জমিতে হবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ। তারপরও কিছু লোক আইন অমান্য করে রাতযাপন শুরু করেন। গত ১ জানুয়ারি থেকে সোনাদিয়ায় রাতযাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো ফাঁড়ি কিংবা সদস্য নেই। দিনের বেলায় বাইরের কেউ সোনাদিয়া ভ্রমণে গেলে বিকেল চারটার আগে তাঁদের দ্বীপ ছাড়তে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যমতে, সোনাদিয়া দ্বীপে বসবাস করেন ৩৩৪ পরিবারে ৮১০ জন নারী-পুরুষ। ভোটার সংখ্যা ৩৮৪। ৮০ শতাংশ মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উৎপাদনে জড়িত।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, একসময় এই দ্বীপ ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশ বিনষ্টের কারণে অনেক কিছুর বিলুপ্তি ঘটেছে। হুমকিতে  আছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য। এখন ইকোট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার নামে অবশিষ্ট প্রকৃতি-সম্পদও ধ্বংস করা হচ্ছে। পৃথিবীতে যে ৩০০–এর মতো চামচঠুঁটো কাদাখোঁচা (স্যান্ডপাইপার) পাখি আছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশ দেখা যায় সোনাদিয়ার প্যারাবনে। প্যারাবন উজাড় করে চিংড়িঘের নির্মাণ করায় চামচঠুঁটোসহ অন্যান্য পাখির বিচরণ চোখে পড়ে না।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.