‘স্ত্রীকে হত্যার ছক দুই বছর আগেই এঁটেছিলেন বাবুল আক্তার’
সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যার দুই বছর আগেই ছক এঁটে সুযোগ খুঁজছিলেন বলে জানিয়েছেন মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসা মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন।
মঙ্গলবার (২ মে) আলোচিত এই খুনের বিচারে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্য দেন মামলার প্রথম সাক্ষী মোশাররফ হোসেন।
যদিও মিতুর বাবার হত্যাকাণ্ডের সময়ের বক্তব্য এবং এখনকার বক্তব্যের ফারাক তুলে ধরেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মিতুর বাবাকে এমন সাক্ষ্য দিতে ‘বাধ্য’ করা হয়ে থাকতে পারে।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। সেদিন সাক্ষ্যগ্রহণ অসমাপ্ত ছিল। সোমবার তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন।
এক সময়ের পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ প্রথম দিনের সাক্ষ্যে বলেছিলেন, বাবুল কক্সবাজার পুলিশে কর্মরত অবস্থায় বিদেশি নাগরিক এক নারী এনজিওকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিতু তা জানতে পারার পর তা নিয়ে দাম্পত্য কলহও হয়েছিল।
মঙ্গলবার মোশাররফ বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদান যাওয়ার আগেই স্ত্রী মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত ছিলেন পুলিশের তৎকালীন এসপি বাবুল। মিতু খুন হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। সেই হিসেবে খুনের ঘটনার দুই বছর আগে পরিকল্পনা করা হয়।
২০১৫ সালে হজে গিয়েছিলেন জানিয়ে সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেন, ‘ওই সময় বাবুল সম্ভবত মিশনে ছিল। ওই নারী (বিদেশি নাগরিক) মিতুর ফোনে কল করে হুমকি দেয়, তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কারণ তাদের (বাবুল ও ওই নারীর) পরকীয়ার কথা লোকজনকে জানিয়ে মিতু নাকি অপপ্রচার করেছিল। (মিতু) ফোনে আমাকে বিষয়টি জানালে আমি মিতুকে ওই নারীর কল রিসিভ না করতে বলি।’
২০১৬ সালের ১ জুন সকালে মিতু তার ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দেওয়ার সময় এই মামলার আসামিরা মিতুকে হত্যার চেষ্টা করেছিল দাবি করে মোশাররফ বলেন, ‘কিন্তু সেদিন মিতু তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে আসায় তাকে হত্যা করতে পারেনি।’
মিতু খুন হওয়ার ঠিক আগে বাবুল চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার ছিলেন। তিনি বদলি হয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিতে ঢাকায় আসার পর চট্টগ্রামে খুন হন মিতু।
মোশাররফ বলেন, ‘বাবুল সম্ভবত ৪ জুন পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করে। পরের দিন বাবুলের ষড়যন্ত্র মোতাবেক আসামি মুসা তার সঙ্গীদের নিয়ে মিতুকে হত্যা করে।’
খুনিদের রক্ষা করতে বাবুল তখন তড়িঘড়ি জঙ্গিদের দায়ী করে একটি হত্যা মামলা করেছিল বলে দাবি করেন মোশাররফ, যে মামলায় এখন আসামি হিসেবে বাবুলেরই বিচার হচ্ছে।
সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেন, ‘আসামি মুসা বাবুলের পূর্ব পরিচিত ও বিশ্বস্ত সোর্স। হাটহাজারী ও চট্টগ্রামের বাসায় মুসা আসা যাওয়া করত। বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে ডিবি অফিসে কর্মরত অবস্থায় মুসাকে ডেকে মিতু হত্যার নির্দেশনা দেয়। তাছাড়া দু-তিনবার মেট্রোপলিটন হাসপাতালের গলিতে মুসাকে ডেকে নিয়ে মিতু হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন।’
মিতুকে হত্যা করতে অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দাবি করে জানিয়ে সাক্ষ্যে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবুল মুসাকে নগদ ৭০ হাজার টাকা অস্ত্র কেনার জন্য দেয়। বাকি ৩ লাখ টাকা পাথরঘাটার প্রেস মালিক সাইফুল ইসলাম পরিশোধ করে দিবে বলে মুসাকে আশ্বস্ত করে। বাবুল আক্তার মিশনে সুদান যাওয়ার অনুমতি পেলে সুদানে যাওয়ার আগে মুসাকে হত্যার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বাসার আশেপাশে রেকি করতে বলে। এও বলে, বাবুল যে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত তা যেন কেউ জানতে না পারে।’
প্রায় এক বছর মিশনে সুদানে থাকাকালে ২-৩ বার বাবুল আক্তার দেশে এসেছিল জানিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘সেসময় এলেও বাসায় থাকেনি। ফিরে যাওয়ার আগে ২-৩ দিন বাসায় থেকেছে। আমরা জানতে পেরেছি, ছুটিতে এসে বারবার মুসাকে হত্যার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে। মিশন শেষে দেশে চলে আসার পর ২০১৫ সালের শেষদিকে আবার আসামি মুসার সাথে তার কথাবার্তা হয়।’
২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রশিক্ষণে বাবুল চীনে গিয়েছিলেন জানিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘ওই সময় মুসাকে বলে, আমি চায়না থাকাকালে মিতু হত্যার কাজটি শেষ করে দিবা। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। তবে বাবুল চায়না থেকে ফেরত আসার পর মুসা জানায়, চেষ্টা করেও কাজটি শেষ করা সম্ভব হয়নি।’
চীনে থাকা অবস্থায় বাবুল ‘জঙ্গিরা বাসা চিনে ফেলেছে’ জানিয়ে মিতুকে নতুন বাসা খুঁজতে বলেছিলেন বলেও জানান মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘বাসা পরিবর্তনের সময় মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল বাবুলের।’
জঙ্গিদের নিয়ে যখন পুলিশ ‘রেড অ্যালার্ট’ দিয়েছিল, তখন বাবুল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তা জঙ্গিদের উপর চালিয়ে দিতে চাইছিলেন বলে দাবি করেন তোর শ্বশুর।
তিনি বলেন, ‘তখন বাবুল নিশ্চিত হয়েছে মিতুকে হত্যা করলে জঙ্গিরা করেছে বলে চালিয়ে দিতে পারবে। ২০১৬ সালের ২৩ মে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্দেশে রওনা হয় বাবুল। যাওয়ার আগে মুসাকে বলে যায়, সে ঢাকা থাকালে যেন মিতুকে হত্যা করা হয়। যাতে কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে। বাবুল মুসাকে বলেছিল, এসময় হত্যা করলে জঙ্গিরা দোষী হবে। আমি হত্যা মামলার তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা হব।’
মিতু হত্যামামলায় মুসা আসামি হলেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তার পরিবারের অভিযোগ, মিতু হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়, তারপর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। পুলিশ অবশ্য মুসাকে আটকের কথা স্বীকার করেনি।
‘আইওদের সব জানিয়েছিলাম’
মিতু হত্যা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ডিবির মো. কামরুজ্জামান, দ্বিতীয় আইও পিবিআই কর্মকর্তা মাঈনুদ্দিন এবং তৃতীয় আইও পিবিআইর সন্তোষ চাকমাকে হত্যাকাণ্ডে বাবুলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানিয়েছিলেন বলে সাক্ষ্যে দাবি করেন মোশাররফ।
তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আইও’র সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। আইও সন্তোষ কুমার চাকমা ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে আমাদের জানায়, তারা তদন্তের শেষ পর্যায়ে। বাবুল আক্তার ও গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছেন। আইও জানান, আমরা মামলার ফাইনাল রিপোর্ট সাবমিট করবো, আপনি এই মামলার বাদি হতে ইচ্ছুক কি না? তখন আমি বলি, পুলিশ মামলা না করলে, আমি নিজেই আমার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে মামলা করব।’
পরে ২০২১ সালের ১২ মে মোশাররফ বাদী হয়ে নগরের পাঁচলাইশ থানায় বাবুলসহ আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে অবশ্য আদালতের নির্দেশে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এখন বাবুলের করা মামলায়ই বিচার চলছে।
মঙ্গলবার জবানবন্দি দেওয়ার পর কিছুক্ষণ মোশাররফকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী। তা শেষ হওয়ার আগেই আদালত ৮ মে পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হওয়ার পর বাবুলের আইনজীবীরা মোশাররফকে জেরা করেন। বাবুলের আইনজীবী মো. তৌহিদুল এহেছান বলেন, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাবুলকে এই মামলায় ফাঁসানোর জন্য সাক্ষ্যে অনেক কাহিনি সাজিয়েছেন তাঁর শ্বশুর। জেরায় এসব কাহিনি খণ্ডন করা হচ্ছে।
এদিকে শ্বশুরের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ার পর আদালতে আসামির কাঠগড়ায় থাকা বাবুল আদালতের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেন, তাঁর মামলার ধার্য দিনে সাদা পোশাকধারী পিবিআই কর্মকর্তারা এখানে ঘোরাফেরা করেন। তাঁরা মামলার তথ্য নিতে এখানে আসেন। ওই সময় আদালত বলেন, মামলার সাক্ষী ছাড়া যে কেউ আদালতে আসতে পারেন। উন্মুক্ত এজলাসেও আসেন অনেকে নানা দাপ্তরিক কাজে।
মঙ্গলবার দুপুরে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাবুলকে আদালতে হাজির করা হয়। ওই সময় তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানও আসে। তারা বাবুলের সাথে কথাও বলে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৬ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি এলাকায় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে নিহত হন মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার পর দিন তার স্বামী বাবুল আক্তার অজ্ঞাত তিন জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। পরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে বাবুল আক্তারসহ সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।