চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলার জেরায় যা যা বললেন তার বাবা

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় তার বাবা মোশাররফ হোসেনকে জেরা শেষ করেছেন আসামি সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের আইনজীবী। জেরার শেষদিনে বাবুলের আইনজীবী দাবি করেন, মোশাররফ ও তার স্ত্রীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা ও সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

বাবুলের আইনজীবী আরও দাবি করেন, মিতু হত্যাকাণ্ডের পর পক্ষে থাকলেও মোশাররফের পরিবারের প্রস্তাব মতো শ্যালিকাকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় পরবর্তীতে তারা বাবুল আক্তারের সঙ্গে বিরূপ আচরণ শুরু করেন। জবাবে মোশাররফ হোসেন আইনজীবীর এসব দাবি নাকচ করেন।

সোমবার (২২ মে) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষী মোশাররফ হোসেনকে জেরা শেষ করেন বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন। বেলা সোয়া ১২টায় মোশাররফকে ষষ্ঠ দিনের মতো জেরা শুরু হয়। মাঝে একদফা বিরতি দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায় জেরা আবার শুরু হয়। সাড়ে চারটায় বাবুলের আইনজীবী জেরা শেষ করেন। এরপর বাকি ছয় আইনজীবীও মোশাররফকে জেরা শেষ করেন। আদালত মঙ্গলবার পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মূলতবি করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মহানগর পিপি আব্দুর রশীদ বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার এজাহার আদালতে উপস্থাপন করা হবে। এজাহারে বাবুলের স্বাক্ষর শনাক্ত করা হবে। এরপর জব্দ তালিকায় যেসব আলামতের বিষয় উল্লেখ আছে সেগুলো উপস্থাপন করা হবে আদালতে। এর ভিত্তিতে মোশাররফ হোসেনকে আবারও জেরা করার সুযোগ পাবেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

জেরায় বাবুলের আইনজীবী ২০১৬ সালের ৩০ জুন একটি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাতকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ওই সাক্ষাতকারে মোশাররফ বলেছিলেন, অনেকে বলছেন বাবুল আক্তার এ ঘটনার সাথে জড়িত, যেটা আমি বিশ্বাস করি না। একই বছরের ৮ জুন দেয়া আরেকটি সাক্ষাতকারে মোশাররফ বলেছিলেন, বাবুল আক্তার কর্মজীবনে সাহসিকতা ও সফলতার স্বাক্ষর রাখায় তার শত্রুরা মিতুকে হত্যা করেছে। একই বছরের ২৬ জুন প্রচারিত একটি সাক্ষাতকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আইনজীবী কফিল উদ্দিন দাবি করেন, সেই সাক্ষাতকারে মোশাররফ বলেছিলেন, ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রী মিতুকে নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে একটি গোষ্ঠী ফায়দা নিতে চায়। জবাবে মোশাররফ হোসেন সাক্ষাতকারগুলো তার নিজের দেয়া বলে স্বীকার করলেও কি বলেছিলেন সেটা স্মরণে নেই বলে জানান।

২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি দেয়া আরেক সাক্ষাতকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মোশাররফের কাছে আইনজীবী জানতে চান- বাবুলের বান্ধবী এসআই আকরামের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে মিতুর খুনের সঙ্গে জড়িত বাবুল আক্তার, এটা তিনি কিভাবে জেনেছেন? এছাড়া বাবুল আক্তার এসআই আকরামের স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন কি না- জানতে চান আইনজীবী।

জবাবে মোশাররফ জানান, বাবুলের সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টি এসআই আকরামের বোন মিতু হত্যার পর বলেছেন। মিতু হত্যার আগে এসআই আকরামের স্ত্রী বাবুল আক্তারের মাগুরার বাসায় আড়াই বছর ছিল। তবে বিয়ে হয়েছিল কি না সেটা তিনি জানেন না।  মিতু হত্যা মামলার আসামি মুসা ‘বাবুল আক্তারের দীর্ঘদিনের পরিচিত বিশ্বস্ত সোর্স’ উল্লেখ করে মোশাররফ যে সাক্ষ্য দিয়েছেন সেটা মিথ্যা দাবি করে আইনজীবী বলেন, মুসা মূলত পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের বিশ্বস্ত সোর্স ছিল।

আইনজীবীর দাবি, বনজ কুমার মজুমদার মোশাররফকে শিখিয়ে দিয়েছেন বাবুলের সোর্স বলার জন্য। বাস্তবে মুসার সঙ্গে বাবুলের সাক্ষাৎ, মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট। জবাবে আইনজীবীর এসব দাবি নাকচ করেন মোশাররফ।

জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ জানান, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মাগুরা সদর ও ঝিনাইদহের শৈলকূপায় বাবুল আক্তারের জায়গা আছে। আইনজীবীর দাবি, কনস্টেবল পদে চাকরি করে মোশাররফ পরিদর্শক পদ থেকে অবসর নেন। চাকরিজীবনে তিনি ঢাকার বনশ্রীর মেরাদিয়াতে ১৮ কাঠা জমির ওপর বাড়ি তৈরি করেন। মোশাররফ এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকেন।

বাবুলের আইনজীবীর দাবি, মিতু হত্যার পর বাবুল যখন তার সন্তানদের নিয়ে মোশাররফের মেরাদিয়ার বাসায় ওঠেন, সেখানে খালাতো এক শ্যালিকা ছিল। মোশাররফ বাবুলকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, শ্যালিকাকে বিয়ে করে তাদের বাসার তিনতলা বাবুলের খরচে নির্মাণ করে থেকে যাওয়ার জন্য। বাবুল রাজি না হওয়ায় মোশাররফের পরিবার বিরূপ আচরণ শুরু করেন। এই প্রস্তাবে অসন্তুষ্ট হয়ে বাবুল ওই বাসা ছেড়ে যাওয়ায় মোশাররফের ইগোতে লাগে এবং এর সুযোগে মিতু হত্যার পরিকল্পনকারীরা তাকে কব্জা করে বলে আইনজীবীর দাবি।

বাবুলের আইনজীবী আরও দাবি করেন, ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি ও ৬ মে পিবিআই হেডকোয়ার্টারে নিয়ে মোশাররফকে ভয়ভীতি দেখানো হয় যে, তাদের প্রস্তুত করা এজাহারে সম্মতি না দিলে এবং সাক্ষ্য না দিয়ে অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদের দায়ে দুদকের মামলায় সারাজীবন জেলে রাখবেন। বাবুল আক্তারের ছেলে-মেয়েকে তাদের সৎ মায়ের সামনে মোশাররফ এই কথাগুলো বলেছিলেন বলে আইনজীবীর দাবি। মোশাররফ হোসেন এসব বক্তব্য নাকচ করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাতজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ১৩ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।

অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া। এতে মুসা ও কালুকে পলাতক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.