শত্রুমর্দনপাড়া থেকে ঢাকার মঞ্চে

যশোদা রানী সূত্রধর । ছবি: দীপু মালাকার

চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে সাদা শাড়ি। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। সুনামগঞ্জ থেকে ভোরে ঢাকায় নেমেছেন, হালকা শীতের সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে রাধারমণ লোকসংগীত উৎসবের উদ্বোধন করলেন। শহর ঢাকা তাঁকে নামে চেনে না, তবে গায়কিতে নিজের জাত চেনাতে সময় নিলেন না প্রবীণ কীর্তনীয়া যশোদা রানী সূত্রধর।
বাংলা লোকগানের অন্যতম পুরোধা রাধারমণ দত্তের গানের সূত্র ধরে জীবনে প্রথম ঢাকায় এসেছেন যশোদা রানী। নজরুল মঞ্চে শহুরে আলোর রোশনাইয়ে খানিকটা আড়ষ্ট তিনি। সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পাগলার শত্রুমর্দনপাড়ার আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা। ভরা পূর্ণিমার রাতে বাড়ির উঠানে রাতভর রাধারমণের গান করতেন, বাদ্যযন্ত্র বলতে তবলা আর হাতে হাতে তালি।
গত ২৫ নভেম্বর বাংলা একাডেমিতে রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত এ উৎসব উদ্বোধন শেষে গান ধরেন যশোদা রানী সূত্রধর। শহুরে বাদ্যযন্ত্র কি-বোর্ড কিংবা সাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে যশোদা রানী সূত্রধরের পরিচয় নেই, তবে মাইক্রোফোন হাতে নেওয়ার পর ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল যাবতীয় আড়ষ্টতা; স্বভাবজাত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘গৌর রূপ হেরিলাম গো।’

প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন যশোদা রানী সূত্রধর।
প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন যশোদা রানী সূত্রধর।

সুরের ক্ষুরধারে জানান দিলেন, রাধারমণের গান গাইতেই তাঁর জন্ম হয়েছে। প্রথম গান শেষে দর্শকের অনুরোধে আবারও কণ্ঠে তুললেন রাধারমণ; বাংলা একাডেমির মাঠে শামিয়ানার নিচে বসে থাকা দর্শকদের সুরের হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন শত্রুমর্দনপাড়ায়—উঠান পেরিয়ে মাঠ, মাঠের আলপথে পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে সুরমা নদী।
গান শেষে মঞ্চ থেকে নামার পর ৭০ ছুঁই ছুঁই এ শিল্পী জানান, রাধারমণের গান গেয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। জীবনসায়াহ্নে এসে ঢাকায় গান করতে পারবেন কখনো ভাবেননি। রাধারমণের গান নিয়ে ২৫ নভেম্বর শুরু হওয়া এ উৎসব শেষ হয় ২৭ নভেম্বর।

রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে রাধারমণের গান সাধনা করেছেন যশোদা রানী সূত্রধর। বলেন, ‘ওনার এলাকায় তাঁকে ছাড়া কোনো গানই হয় না। জাতীয়ভাবে তিনি পরিচিত না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে রাধারমণের গানের জন্য প্রশংসিত ও পরিচিত একজন শিল্পী।’
শৈশব থেকেই গানের সঙ্গে পরিচয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ওস্তাদের কাছে গান শেখেননি যশোদা রানী। মা ও দাদির মুখে রাধারমণের গান শুনে শুনে মুখস্থ করতেন। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে এসে নামের মতোই দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। লোকসংগীত-গবেষক সুমনকুমার দাশ জানান, কীর্তন, ধামাইল, সূর্যব্রত, নারীসংগীতসহ অনেক প্রাচীন গান জানেন যশোদা রানী সূত্রধর।

যশোদা রানী সূত্রধর।
যশোদা রানী সূত্রধর।

এই গবেষক বলেন, লোকগানের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে আঞ্চলিকতা। যশোদা রানী সূত্রধরের বিশিষ্টতাও সেখানে। তিনি সিলেটের আঞ্চলিক উপভাষায় রচিত গানকে অবিকৃতভাবে অবিকল সুরে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশন করে আসছেন। তাঁর মতো দাপুটে কণ্ঠের অধিকারী হাওরাঞ্চলে খুব কমই আছেন। এমন শিল্পীর কথা শহুরে মানুষেরা প্রায় জানেন না বললেই চলে।
গান করতে গিয়ে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে যশোদা রানী সূত্রধরকে। তারুণ্যে গ্রামের চৌহদ্দির বাইরে গান করতে যেতে পারেননি। শুধু গানে নয়, জীবনে টিকে থাকার লড়াইও তাঁকে করতে হয়েছে। একসময় স্বামীকে হারিয়ে অল্প বয়সী তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন, অনেকটা যুদ্ধ করেই সন্তানদের বড় করে তুলতে হয়েছে তাঁকে।

জীবনযুদ্ধের মধ্যেও গান চালিয়ে গেছেন যশোদা রানী; গানের বিনিময়ে কখনো কারও কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেননি। তা নিয়ে তাঁর কোনো খেদও নেই। তবে রাধারমণের গানের সুর দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ করলেন এ প্রবীণ শিল্পী।
আগে পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় আয়োজনে, বিয়েবাড়ি, ভাইফোঁটা কিংবা গানের আসরে ডাক পড়ত। তাঁর সঙ্গে ৮ থেকে ১০ জন শিল্পীর একটি দল ছিল। তাঁদের বেশির ভাগই এখন আর নেই। অনেকে মারা গেছেন; কেউ কেউ বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ।
যশোদা রানীও আগের মতো গান করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘এহন তো গাইতাম পারি না, অহন তারারে (পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী) সুর দেই, গান ধরে দেই। গাইতাম পারি না। শ্বাস ফিরিয়া আনতাম পারি না।’ বয়সের ভারে তাঁর চোখের দৃষ্টিও কমে এসেছে। দিন দিন চশমার ‘পাওয়ার’ বেড়েই চলেছে।

মঞ্চে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে যশোদা রানী সূত্রধর।
মঞ্চে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে যশোদা রানী সূত্রধর।

পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রাচীন গানের সুর ছড়িয়ে দিতে চান যশোদা রানী। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলেও টুকটাক গান করেন। পরিবারের মধ্যে তাঁর ভাতিজি নীপা সূত্রধরের ধামাইলগানের একটি দল আছে। ২০১৬ সাল থেকে ঢাকায় নিয়মিত গান করেন নীপা। তিনি জানান, তাঁর পিসিমণি ও মা-বাবার সহযোগিতায় ঢাকায় এসে গান করতে পারছেন। সেই সময়ে কারও সহযোগিতা পেলে যশোদা রানী সূত্রধরও ঢাকায় এসে গান করতে পারতেন।
নীপা সূত্রধরের মাধ্যমে যশোদা রানী সূত্রধরের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র। পিসিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন নীপা। তিনি বলেন, ‘পিসিমণির কাছে গানের সুর তুলে নিই। আমাদের এলাকার যাঁরা জ্যেষ্ঠ শিল্পী আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মারা গেছেন। তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন গানের মূল সুরও হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে গ্রামের এক শিল্পীর কাছে সুর তুলে নিতে গিয়ে শুনি তিনি মারা গেছেন।’
যশোদা রানী সূত্রধরের মতো প্রবীণ শিল্পীরা একে একে চলে যাচ্ছেন, সঙ্গে রাধারমণের গানের মূল সুরও হারিয়ে যাবে কি না, এ শঙ্কার কথা জানালেন তরুণ প্রজন্মের শিল্পী নীপা সূত্রধর।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.