চেনা-পরিচিত সকলে জ্বরে আক্রান্ত : চীনে করোনা এখন এমনই

করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন একজন চীনা নাগরিক । ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘যদি এই মুহূর্তে চীনের বাইরে থাকেন, তাহলে ফিরে আসবেন না’—এই আহ্বান চীনের একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন এক ব্যক্তি। সম্প্রতি চীনে ফিরেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি কয়েক বছর ধরে দেশের বাইরে ছিলাম। এ সময় একবারের জন্যও আমার করোনা হয়নি। তবে দেশে ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই আক্রান্ত হলাম। আমার চেনা-পরিচিত সবার করোনা হচ্ছে এবং শরীরে জ্বর।

উইবোতে একজন লিখেছেন, ‘গত তিন বছরে আমাদের অফিসে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। হঠাৎ করে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলো, আর বলা হলো, আপনি অসুস্থ হয়েও কাজে যেতে পারবেন। পিঁপড়ার মতোই আমাদের জীবনেরও যেন কোনো মূল্য নেই।’

চীনে হুহু করে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। হঠাৎ ভাইরাসটির এই বাড়বাড়ন্ত কেন? ফিরে যাওয়া যাক একটু পেছনের দিকে। করোনা রুখতে চীন সরকারের জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন দেশটির বাসিন্দারা। এরপর চলতি বছরের শুরুতে অনেক বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে সংক্রমণ। পরিস্থিতি এখন এতটাই খারাপ যে দেশটির হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সামলাতে পারছে না।  

করোনা পরীক্ষার জন্য চীনাদের লাইন
করোনা পরীক্ষার জন্য চীনাদের লাইন

শুধু করোনার ধাক্কাই নয়। বিপত্তি আরও আছে। বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর নতুন একটি ঘোষণা দিয়েছে ঝেজিয়াং ও আনহুই প্রদেশ এবং চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ। ঘোষণা অনুযায়ী, কারও শরীরে যদি করোনার অল্প উপসর্গ থাকে কিংবা কোনো উপসর্গ না থাকে, তাঁকে কাজে যেতে হবে। গত সোমবার থেকে এই ঘোষণা সংশ্লিষ্ট হ্যাশট্যাগ চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে ৩ কোটি ৩০ লাখ বারের বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হাঁটু গেড়ে গুয়াংডং প্রদেশের একটি হাসপাতালে বসে আছেন, সন্তানের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে আরজি জানাচ্ছেন তিনি। জবাবে বাধ্য হয়ে এক চিকিৎসক বলেন, ‘ছয়-আট ঘণ্টা ধরে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে—কী শিশু, কী বৃদ্ধ। আপনিই একা নন।’

ওই হ্যাশট্যাগ ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই আতঙ্ক ও ভয়ের কথা প্রকাশ করেছেন। যেমন উইবোতে একজন লিখেছেন, ‘গত তিন বছরে আমাদের অফিসে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। হঠাৎ করে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলো, আর বলা হলো, আপনি অসুস্থ হয়েও কাজে যেতে পারবেন। পিঁপড়ার মতোই আমাদের জীবনেরও যেন কোনো মূল্য নেই।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘মাত্র কয়েক মাস আগেও লোকজন করোনা পজিটিভ হয়ে কাজে গেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হতো।’  

শরীরে করোনা নিয়ে চীনারা কীভাবে দিন পার করছেন, গত দুই সপ্তাহে এমন সব ভিডিওর বন্যা বয়ে গেছে দেশটির ইন্টারনেটে। চীনের গণমাধ্যমের প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, তরুণ-তরুণীরা তাঁদের অসুস্থ বাবা-মায়ের জন্য খাবার ও পানি নিয়ে যাচ্ছেন। একই বাড়ির মধ্যে থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনেককে দেখা গেছে ভিন্ন সব কৌশল বেছে নিতে। অনেকেই আবার ব্যথানাশক ওষুধ কিনে তা পৌঁছে দিচ্ছেন অসুস্থ মানুষের কাছে।

এরই মধ্যে চিকিৎসাকর্মী ও করোনা মোকাবিলায় কাজ করা সম্মুখসারির লোকজনের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে চীনের নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নিউজপোর্টাল দ্য পেপারের কথা। চেংডু শহরের সরকারি সেবাদানকারী একজন টেলিফোন অপারেটরের সঙ্গে এক ব্যক্তির কথোপকথন তুলে ধরেছে তারা। কথোপকথনে ওই টেলিফোন অপারেটরকে কাশতে শোনা যায়। এ সময় ওই ব্যক্তি তাঁকে বলেন, ‘উদ্বিগ্ন হয়েন না। কোনো সমস্যা নেই। আপনি নিজের খেয়াল রাখেন।’

চীনের জন্য ইতিবাচক বিষয়গুলো প্রায়ই দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো প্রচার-প্রচারণা বেশি করে। গত ২৪ ঘণ্টায় একটি হ্যাশট্যাগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সেটি হলো #পারসিসটেন্ট_ডক্টর_অ্যান্ড_নার্স_ওয়ার্ক_হার্ড, যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘চিকিৎসক ও নার্সদের একটানা হাড়ভাঙা খাটুনি’। একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসাকর্মী ও সম্মুখসারির কর্মকর্তাদের প্রশংসায় মেতেছে চীনের সরকারি গণমাধ্যমগুলো।

তবে স্বাধীন গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের কথা ভিন্ন। গত সপ্তাহে তাদের প্রতিবেদনগুলোতে দেখা গেছে চীনের মেডিকেল শিক্ষার্থীরা নতুন করে বিক্ষোভ করছেন। তাঁদের দাবি, আরও ভালো বেতন এবং সম্মুখসারির কর্মকর্তাদের সুরক্ষা।

চীনের ‘শূন্য করোনা নীতির’ আওতায় কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ঠিক একইভাবে গত মাসে বিক্ষোভ করেছিলেন দেশটির বিভিন্ন শহরের সাধারণ লোকজন।

চীনা সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অবসরে গেছেন এমন হাজার হাজার চিকিৎসাকর্মীকে সম্মুখসারিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে দেখা গেছে রোগীদের লম্বা লাইন। সব মিলিয়ে ব্যাপক চাপে রয়েছে হাসপাতালগুলো।

বড় অনেক শহরের সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্বীকার করা হয়েছে, সাধারণ মানুষের জরুরি চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে ফোনকল করার পরিমাণ বেড়েছে। অতি জরুরি না হলে কল না করার জন্যও তাদের কাছে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সেবা দিতে গিয়ে ক্লান্ত অনেক চিকিৎসাকর্মীর ভিডিও উইবোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনই একটি ভিডিও গত ২৪ ঘণ্টায় ১ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হাঁটু গেড়ে গুয়াংডং প্রদেশের একটি হাসপাতালে বসে আছেন, সন্তানের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে আরজি জানাচ্ছেন তিনি। জবাবে বাধ্য হয়ে এক চিকিৎসক বলেন, ‘৬-৮ ঘণ্টা ধরে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে—কী শিশু, কী বৃদ্ধ। আপনিই একা নন।’

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.