ইসলামপন্থী থেকে প্রগতিশীলদের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম

মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের নাম চার দশকের পুরোনো। দেশটির ক্ষমতার শীর্ষে তাঁর রূপকথার প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নতুনই বলা চলে। নানা নাটকীয়তার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভাবশালী দেশটির ১০ম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম কিছুদিন আগেই। অবসান হয়েছে তাঁর ২৫ বছরের অপেক্ষার। বিরোধী নেতা হিসেবে ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আনোয়ারের সামনে এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরও বড় পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। কারণ, এমন সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন দেশটির রাজনীতি চরম বিভক্ত আর অর্থনীতি অস্থিতিশীল।

মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে হলে এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আনোয়ারকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশটিকে আগের অবস্থায় ফেরাতে হবে। আর বহু ধারায় বিভক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে একসময় ইসলামি ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া আনোয়ারকে সামলাতে হবে কট্টর ইসলামপন্থীদের। এবারের নির্বাচনে একক দল হিসেবে তারা সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে।

কুয়ালালামপুরভিত্তিক মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শংকরন নাম্বিয়ার বলেন, মালয়েশিয়ার ইতিহাসের এ পর্যায়ে দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই লড়াইয়ের সময় দেশটিকে আসন্ন জটিল অবস্থা থেকে বের করে আনতে আনোয়ারকে ভালোই প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।

আনোয়ারের উত্থান

আনোয়ারের ওঠে আসা রাজনৈতিক পরিবার থেকেই। তিনি ১৯৪৭ সালের আগস্টে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ইব্রাহিম আবদুল রহমান ছিলেন পার্লামেন্ট সদস্য। আর মা চে ইয়ান হুসেইন ছিলেন উত্তরাঞ্চলীয় পেনাং রাজ্যের রাজনৈতিক সংগঠক। তখন ওই অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন আনোয়ার। তিনি ফিলিপাইনের বিপ্লবী নায়ক জোসে রিজালের প্রতি তাঁর প্রশংসার কথা বলে আসছেন। আনোয়ার তাঁকে ‘একজন সত্যিকারের এশীয় রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মালয়েশিয়ার ইসলামি যুব আন্দোলন আংকাতান বেলিয়া ইসলাম মালয়েশিয়ার (এবিআইএম) মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন আনোয়ার। তিনি কুয়ালালামপুরে বিভিন্ন ইসলামি যুব সংগঠনের নেতৃত্ব দেন।

‘আমাদের নানা ধারায় বিভক্ত দেশটির জন্য আনোয়ারই সঠিক ব্যক্তি। মাহাথিরের জাতি-কেন্দ্রিক শাসনের ধারা থেকে আনোয়ার সরে আসছেন’

আমিরুল রুসলান, মালয়েশিয়ার সাংবাদিক

গ্রামীণ অঞ্চলের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তারও হন আনোয়ার। তবে সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন। এটি ছিল মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে সংগঠনটির ছয় দশকের দাপটের মাঝামাঝি সময়। ওই সময় ইউএমএনওর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, যিনি ছিলেন একই সঙ্গে আনোয়ারের পরামর্শক ও শাস্তিদাতা।

মাহাথিরের সঙ্গে বিরোধ

রাজনীতিতে তরতর করে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন আনোয়ার। মাহাথিরের দলে যোগ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে আসীন হন তিনি। ১৯৯৩ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, তিনি মাহাথিরের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন। কিন্তু দুর্নীতি ও অর্থনীতি নিয়ে বিরোধে জড়ান দুই নেতা।

আনোয়ার ইব্রাহিম (ডান থেকে দ্বিতীয়) ১৯৮২ সালে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন
আনোয়ার ইব্রাহিম (ডান থেকে দ্বিতীয়) ১৯৮২ সালে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন

এই দুই নেতার মধ্যে সংঘাত চরম আকার ধারণ করে ১৯৯৭ সালে, যখন এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির অবস্থা জেরবার। পরের বছর মাহাথিরের মন্ত্রণালয় থেকে আনোয়ারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বরখাস্ত করা হয় দল থেকেও। এরপর মাহাথিরের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই বিক্ষোভকে নতুন গণতান্ত্রিক আন্দোলন মনে করা হচ্ছিল।

আনোয়ারের এই আন্দোলন মাহাথিরের জন্য ছিল চরম অস্বস্তির। বলা হয়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য কিছুটা তাড়াহুড়োই করে ফেলেন আনোয়ার। বিষয়টি টের পেয়েই তার ওপর খড়্গহস্ত হন মাহাথির। ওই বছরই আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামী যৌনতার অভিযোগ আনা হয়। তিনি দৃঢ়ভাবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন।

কেন সমকামিতার অভিযোগ

দুর্নীতির পাশাপাশি আনোয়ারের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল সমকামী যৌনাচারের অভিযোগ। আনোয়ারের বিরুদ্ধে আনা দ্বিতীয় অভিযোগটি শুধু তাঁকে শাস্তি দিতেই নয়, বরং তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দিতেই আনা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জন–অধ্যুষিত দেশ মালয়েশিয়ায় সমকামিতার সাজা ২০ বছরের কারাদণ্ড। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এ বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল।

কার্যত চরিত্র হননের মাধ্যমে আনোয়ারের জনপ্রিয়তা ও মুসলিম ভোট ব্যাংকে ধস নামাতেই তাঁর বিরুদ্ধে এমন স্পর্শকাতর অভিযোগ আনা হয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে ১৯৯৯ সালে তাঁকে ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়। সমকামিতার অভিযোগে পরের বছর আরও নয় বছরের সাজা যোগ হয়। মূলত এই সাজা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

‘এই নেতা ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক রাজনৈতিক অবিচারের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আশা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পালনকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রণীত আইন ও বিধিগুলো সংস্কার করবেন তিনি’

ফিল রবার্টসন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক

মাহাথির প্রথম দফায় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার এক বছর পর ২০০৪ সালে সমকামিতার দায়ে দেওয়া সাজা বাতিল করে দেন আদালত। কারাগার থেকে বেরিয়েই নির্বাচনে বাজিমাত করেন আনোয়ার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট এক-তৃতীয়াংশ আসন পায়। পরে ২০১৩ সালের নির্বাচনে তাঁর জোট আরও ভালো ফলাফল করে, কিন্তু তা সরকারের গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আরও সমকামী যৌনতার অভিযোগে ২০১৫ সালে ফের আনোয়ারকে কারাগারে যেতে হয়।

মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন আনোয়ার ইব্রাহিম
মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন আনোয়ার ইব্রাহিম

আনোয়ারের জখম হওয়া চোখই দলের লোগো

আনোয়ারের গ্রেপ্তারের ঘটনায় রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর চালানো নিপীড়নের সঙ্গে তাঁর ঘটনাকে তুলনা করা হয়। কারাগারে আনোয়ারের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তৎকালীন পুলিশপ্রধানের ঘুষিতে আনোয়ারের বাম চোখের চারপাশ কালো হয়ে যায়। আঘাতে তাঁর ঠোঁট ফেটে যায়। নির্যাতনের ওই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

আনোয়ার যখন কারাগারে তখন তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল পিপলস জাস্টিস পার্টি (পিকেআর) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলের লোগো করা হয় নির্যাতনে আনোয়ারের জখম হওয়া ওই চোখের আদলে। মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ারকে নিয়ে দলকে এগিয়ে নেন তিনি।

তৎকালীন পুলিশপ্রধানের ঘুষিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের বাম চোখের চারপাশ কালো হয়ে যায়
তৎকালীন পুলিশপ্রধানের ঘুষিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের বাম চোখের চারপাশ কালো হয়ে যায়

নুরুল ইজ্জাহ ২০০৮ সাল থেকে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসলেও সবশেষ নির্বাচনে তিনি কট্টর ইসলামপন্থী এক প্রার্থীর কাছে হেরে যান। কারাগার থেকে বেরিয়ে এই দলটিকেই শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেন আনোয়ার। অন্যদের সঙ্গে জোট বাঁধার পর ২০০০ সাল থেকেই নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে আসছে দলটি।

দাবি উঠেছিল সরে দাঁড়ানোর

আনোয়ার তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দল ও জোটের ভেতর থেকে বড় চাপে পড়েন গত বছরের শেষের দিকে। মেলাকা রাজ্যের নির্বাচনে পাকাতান হারাপান জোট বাজে ফলাফল করে। এরপর দাবি ওঠে আনোয়ারের সরে দাঁড়ানোর। কারণ, এই ফলাফলের কারণে পরের সাধারণ নির্বাচনে ভালো করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। অনিশ্চয়তা পড়ে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও।

আনোয়ারে উত্তরসূরি ভাবা হয় মেয়ে নুরুল ইজ্জাহকে। এ ছাড়া নেতৃত্বের দৌড়ে আছেন পিকেআরের সহসভাপতি রাফিজি রামলি। গত কয়েক বছর ধরে নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন রাফিজি। প্রাদেশিক নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার পর টুইটে তিনি বলেন, পাকাতান নেতারা ফলাফল নিয়ে ভাববেন বলে তিনি আশা করেন। অহংকার ত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে ভালো ফলাফলের চেষ্টা করবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

রূপকথার প্রত্যাবর্তন

বিগত কয়েকটি বছরে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাজিব রাজাকের সরকারকে হঠাতে জেলে থেকেই সেই মাহাথিরের সঙ্গে জোট গড়েন আনোয়ার। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিলের অর্থ তছরুপের অভিযোগ ওঠা নাজিবকে হঠাতে শেষ বয়সে ফের রাজনীতিতে ফেরেন মাহাথির। এ প্রচেষ্টায় আসে সাফল্যও। উপনির্বাচনে পার্লামেন্ট সদস্য হন আনোয়ার। এটা ছিল তাঁর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা।

নির্বাচনী জোট গঠনে সমঝোতা হয়েছিল, বিজয়ী হলে আনোয়ারকে মুক্ত করবেন মাহাথির। আর মাহাথির দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে আনোয়ারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। মাহাথির প্রথম প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। রাজকীয় ক্ষমার মাধ্যমে আনোয়ারকে কারামুক্ত করেন। কিন্তু আনোয়ারের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার শর্ত থেকে সরে আসেন। একপর্যায়ে এ নিয়ে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে ২০২০ মাহাথিরের সরকারের পতন হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন থাকার কথা ঘোষণা দিয়ে তা প্রমাণ করতে না পেরে দুই দফা চেষ্টা করেও তখন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি আনোয়ার।

মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান আবদুল্লাহ সুলতান আহমাদ শাহ ও রানি আজিজাহ আমিনাহ মাইমুনাহর সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম ও তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল (ডানে)
মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান আবদুল্লাহ সুলতান আহমাদ শাহ ও রানি আজিজাহ আমিনাহ মাইমুনাহর সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম ও তাঁর স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল (ডানে)

ইসলামপন্থী ছাত্রনেতার চ্যালেঞ্জ কট্টর ইসলামপন্থীরা

আনোয়ারের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, তাঁকে অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। দ্বিতীয়, নিজের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলকে সঙ্গে নিয়ে গড়া ঐক্যের সরকার টিকিয়ে রাখতে হবে। তৃতীয়ত, মানবিক অর্থনীতি চালুর যে প্রতিশ্রুতি তিনি নির্বাচনের আগে দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে একসময়কার মুসলিম ছাত্রনেতার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে কট্টর ইসলামপন্থী দল পার্টি ইসলাম সে-মালয়েশিয়া (পিএএস)।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিনের পেরিকাতান নাসিওনালের সঙ্গে জোট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেয় পিএএস। একক দল হিসেবে তারা সর্বোচ্চ ৪৯টি আসন পেয়েছে যা আগের নির্বাচন থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। দলটি মালয়েশিয়ায় শরিয়া আইন চালুর পক্ষে। নির্বাচনী প্রচারণায় দলটির এক নেতা বলেছিলেন, আনোয়ারের জোটকে কেউ ভোট দিলে, সে জাহান্নামে যাবে। এমনকি আনোয়ারকে ‘ইসরায়েলের গুপ্তচর’ বলে মন্তব্য করেছেন পিএএসপ্রধান আবদুল হাদি আওয়াং।

ইসলামপন্থীদের উত্থান চীনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।সর্বশেষ নির্বাচনে প্রগতিশীল জোটের নেতৃত্ব দিয়েছেন আনোয়ার। জোটে চীনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়েছেন তিনি। ফলে একসময়কার ইসলামপন্থী ছাত্রনেতার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিকে ব্যালটে সমর্থন দিয়েছেন ভোটাররা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই সান ওহ বলেন, ‘বিভক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে একটি অস্বাভাবিক জোটে প্রবেশ করেছেন তিনি (আনোয়ার)। সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেছে দেশ কতটা বিভক্ত। প্রগতিশীল অংশ ও রক্ষণশীল শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা তাঁর জন্য কঠিন হবে।’

আনোয়ার কেন সেরা বিকল্প

মাহাথিরের দীর্ঘ শাসন আমলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করলেও মালয়েশিয়া অনেকটা এক ব্যক্তি ও একদলীয় শাসনের মধ্যে ছিল। একদলীয় শাসনের ফলে দুর্নীতি গেড়ে বসে। ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মতো মানবাধিকারের বিষয়গুলো সীমিত হয়। তাই সংস্কারের মানসিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আনোয়ারই আস্থা রেখেছেন ভোটাররা। পাশাপাশি বর্তমানে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রয়োজন। এ জন্য দরকার আরও উদার ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। দেশটির নব্বইয়ের দশকের মন্দা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আনোয়ারের। ফলে ভোটাররা আনোয়ারকে ভালো বিকল্প হিসেবে দেখেছেন।

আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বিশেষ করে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে তাঁর প্রতিশ্রুতির জন্য। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, ‘এই নেতা ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক রাজনৈতিক অবিচারের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আশা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পালনকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রণীত আইন ও বিধিগুলো সংস্কার করবেন তিনি।’

মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। পাশে বসা তাঁর স্ত্রী সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল
মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। পাশে বসা তাঁর স্ত্রী সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল

মালয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশটির জনসংখ্যার বড় একটি অংশ চীনা ও ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। রাজনীতিতে জাতিগত বিভক্ত ক্রমশ বেড়েছে। ভোটের রাজনীতিতে আগের শাসকগোষ্ঠী মালয় ও ইসলামপন্থীদের দিকে ঝুঁকেছে। এ ছাড়া ইসলামপন্থীদের উত্থান চীনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।সর্বশেষ নির্বাচনে প্রগতিশীল জোটের নেতৃত্ব দিয়েছেন আনোয়ার। জোটে চীনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়েছেন তিনি। ফলে একসময়কার ইসলামপন্থী ছাত্রনেতার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিকে ব্যালটে সমর্থন দিয়েছেন ভোটাররা।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে আনোয়ারের ঐক্যের সরকার গঠনকে নজিরবিহীন হিসেনে আখ্যায়িত করছেন মালয়েশিয়ার সাংবাদিক আমিরুল রুসলান। তিনি বলেন, ‘নানা ধারায় বিভক্ত আমাদের দেশটির জন্য আনোয়ারই সঠিক ব্যক্তি। মাহাথিরের জাতি-কেন্দ্রিক শাসনের ধারা থেকে আনোয়ার সরে আসছেন।’

তথ্যসূত্র: সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, আলজাজিরা ও রয়টার্স

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.