পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের পথের কাঁটা ‘আবাস যোজনা’র দুর্নীতি

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে রাজ্যব্যাপী রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠেও নেমে পড়েছে। কিন্তু এবার এই নিবাচনে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ। চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতির পর এবার সবশেষ যে দুর্নীতি তৃণমূলকে কুঁকড়ে খাচ্ছে, তা হলো প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা প্রকল্পের দুর্নীতি।

আবাস যোজনায় ভারত সরকার এই রাজ্যে গরিবদের পাকাবাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮৩টি পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর গরিবদের এই পাকাবাড়ি দেওয়ার তালিকা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পঞ্চায়েত দপ্তরকে। রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তর ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে যে তালিকা প্রস্তুত করেছে, তাতে দেখা গেছে প্রকৃত ভূমিহীনদের পরিবর্তে আবাসগৃহ বরাদ্দ করা হয়েছে শাসকদলের বহু নেতা, কর্মী এবং তাদেরই সমর্থক বহু বিত্তবানদের। কারও কারও রয়েছে তিনতলা পাকাবাড়িও। আর এই নিয়ে তালিকা প্রকাশের পর রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গরিব মানুষেরা, যাদের নাম ওঠেনি ওই তালিকায়। এই নিয়ে রাজ্যজুড়ে চলছে শাসকদলের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এটা মেনে নিতে না পেরে রাজ্যজুড়ে শাসকবিরোধী আন্দোলন জোরদার করেছে। এই আন্দালনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার এই দুর্নীতির খবর সরেজমিন তদন্তের জন্য দিল্লি থেকে প্রতিনিধিদলও পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। প্রতিনিধিদল তদন্ত করে দেখছে প্রকাশিত তালিকায় সত্যি কি বিত্তবানেরা বাড়ি পেয়েছেন কি না। রাজ্যব্যাপী এই দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলন শুরু হলে রাজ্য সরকার বাধ্য হয়ে এখন ওই তালিকা থেকে কিছু কিছু নাম বাদ দিচ্ছে।

পঞ্চায়েতের আগে আবাস যোজনার এই দুর্নীতি শাসক দলের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
গতকাল শনিবার এই রাজ্যের হাওড়ার শ্যামপুকুরের তৃণমূল বিধায়ক কালীপদ মণ্ডলও স্বীকার করে নিয়েছেন, আবাস যোজনায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগকে। তিনি গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিভিন্ন থানার বিডিওরা যে তালিকা প্রস্তুত করেছে, সেখানে গরিবদের পরিবর্তে বিত্তবানদের নাম উঠেছে। নাম উঠেছে তিনতলা পাকাবাড়ি আছে এমন অনেকের, তবে নাম উঠেনি বহু গরিব মানুষের। দলের বিধায়কের মুখে এ কথা উঠার পর রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার কার্যত অস্বস্তিতে পড়েছেন। তিনি বলেন, এভাবে বিধায়কের মন্তব্য করা উচিত হয়নি। দলীয় স্তরে এসব অভিযোগের সমাধান করা উচিত ছিল।

আবাস যোজনার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে গরু চুরির অভিযোগ পর্যন্ত আছে তৃণমূলের বাঘা বাঘা নেতাদের বিরুদ্ধে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় এখন দলটির নেতা সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কারাগারে। গরু পাচার মামলায় দলটির বীরভূম জেলার দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলও কারাগারে।

এদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করেছে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, এই পঞ্চায়েত নির্বাচন তদারক করা হোক হাইকোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারক দ্বারা। আবেদনে শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ তুলেছেন, রাজ্যের শাসক দল হিংসা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচন করতে চাইছে। তাই এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করার দাবি তুলেছেন তিনি।

যদিও সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ স্বীকার করে নিয়েছেন, সবশেষ ২০১৮ সালের পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের নির্বাচনের পদ্ধতি ভুল ছিল। সেই ভুলকে শুধরিয়ে এবার এই রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করতে চায় তৃণমূল।

২০১৮ সালের ১৪ মে সবশেষ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস করেছিল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের ২০টি জেলার এই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল এক দিনে। ভোটদানে বাধা, ব্যালট ছিনতাই, এজেন্টকে ঢুকতে বাধা, ব্যালট মেশিন ইভিএম ভাঙচুর, লুট করা, জোর করে নিজেদের দলের প্রতীকে ভোট দান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনের দিন ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এক-তৃতীয়াংশ আসনে কোনো নির্বাচনই করতে দেয়নি তৃণমূল। তাদের নিজেদের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে।

ওই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীসহ তৃণমূল জয়ী হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩৮ হাজার ১১৮টি আসনে। বিজেপি জয়ী হয় ৫ হাজার ৭৭৯টি আসনে, বাম দল জয়ী হয় ১ হাজার ৭১৩টি আসনে। আর কংগ্রেস জয়ী হয় ১ হাজার ৬৬টি আসনে। আর পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল ৮ হাজার ৬২, বিজেপি ৭৬৯, বাম দল ১২৯ ও কংগ্রেস ১৩৩টি আসনে জয়ী হয়। আর জেলা পরিষদে তৃণমূল জয়ী হয় ৭৯৩টি, বিজেপি ২২টি, কংগ্রেস ৬টি আর বাম দল ১টি আসনে।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.