অস্তিত্ব সংকটে গড়াই নদ

পলি জমে গড়াই নদীতে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। সম্প্রতি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির নাড়ুয়া ইউনিয়নের খেয়াঘাট এলাকায়।

গড়াই প্রমত্ত পদ্মার শাখানদ। কুষ্টিয়ার হাটশহরিপুর ইউনিয়নে পদ্মা থেকে জন্ম নিয়ে এটি প্রবাহিত হয়েছে পাঁচটি জেলার মধ্য দিয়ে। কুষ্টিয়া ছাড়াও রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও ফরিদপুর হয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। কিন্তু ৮৬ কিলোমিটারের এই নদ রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার অংশে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। স্রোত কিংবা নৌযান চলা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব রক্ষাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে গড়াইয়ের জন্য।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নদে পলি জমে অসংখ্য চরে ভরে গেছে। মৃতপ্রায় গড়াইয়ের কোথাও কোথাও পানি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হেঁটেই পার হওয়া যায় ।

জানা গেছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল এবং অবৈধভাবে খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করায় নদটি অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। শুধু গড়াই নয়, বালিয়াকান্দির ওপর দিয়ে বয়ে চলা চন্দনা, চত্রা, হড়াই ও পুষস্বলী নদ-নদীও পানিশূন্য।

বছরে কোনোরকমে দু-তিন মাস পানি থাকলেও বাকি ৯ মাস পানি একেবারেই থাকে না। শুধু বালু আর বালু। নদে পানি না থাকায় এই অঞ্চলের পরিবেশও হুমকির সম্মুখীন। কৃষক ও জেলেদের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে আমূল পরিবর্তন। অনেক জেলে পেশা ছেড়ে আয়ের ভিন্ন উৎসের খোঁজে রয়েছেন।

বালিয়াকান্দির নারুয়া ও জঙ্গল ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই নদে দেখা যায়, ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে; সেগুলোর মধ্যে কোথাও পানি, কোথাও বালুচর। কোথাও আবার  সরু হয়ে খালে পরিণত হয়েছে। কোনোরকম পানির অস্তিত্ব রয়েছে সেই খালে। আর সম্পূর্ণ নদের বুক চিরে বালুচর। স্থানীয় মানুষজন বালুচর দিয়ে হেঁটে গড়াই পার হচ্ছেন।

নদীর পাশের এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজবাড়ী অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে ‘মরণ বাঁধ’ ফারাক্কা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। এ বাঁধের ফলে পানিসংকটে ভুগছে পদ্মা নদী। ফলে পদ্মার শাখানদী গড়াইও পানিশূন্য অবস্থায় পড়েছে। এ জন্য গড়াই নদসহ চন্দনা, হড়াই, চত্রা ও পুষস্বলী নদ-নদীতে পানি থাকছে না। কারণ, সব নদীর উৎসমুখ পদ্মা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব নদ-নদী বছরে ৯-১০ মাস পানিশূন্য থাকায় এই অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বর্ষাকালে এসব নদ-নদীতে কিছুদিনের জন্য পানি থাকলেও প্রায় সারা বছর পানিশূন্য থাকে। আর এই সুযোগে প্রভাবশালী দখলদারেরা নদ-নদীর দুই পাশ দখল করে নিচ্ছে। পানির অভাবে এর অববাহিকায় ফসল আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কল্লোল বসু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পানিবণ্টন নীতিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ না করা এবং ফারাক্কা বাঁধের নেতিবাচক প্রভাবে গড়াইসহ অন্যান্য নদ-নদী মরে যাচ্ছে। এগুলো বাঁচানো খুবই জরুরি হয় পড়েছে। এসব বাঁচলে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক বাঁচবেন।’

বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকার মৃতপ্রায় নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চন্দনা নদীটি পুনঃখনন করা হয়েছে। গড়াই নদের খননকাজ উৎপত্তিস্থল কুষ্টিয়ায় হয়েছে। আশা করছি, এদিকে খননকাজ শুরু হলে নদ-নদীগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে। এই অঞ্চলের কৃষকেরাও উপকৃত হবেন।’

গড়াই নদ-মধুমতী নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা ও দীর্ঘ। গড়াই নামে ৮৯ কিলোমিটার, মধুমতী নামে ১৩৭ কিলোমিটার এবং বলেশ্বর নামে ১৪৬ কিলোমিটার। গড়াইয়ের বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে- কুমার নদ, কালীগঙ্গা, ডাকুয়া, বুড়ি গড়াই, বুড়িশাল ইত্যাদি গড়াইয়ের শাখা। তা ছাড়া নবগঙ্গা নদী, চিত্রা, কপোতাক্ষ, সাতক্ষীরার যমুনা, গোলঘেসিয়া, এলেংখালী, আঠারোবাঁকি প্রভৃতি নদী এর সংস্পর্শে এসেছে। এ ছাড়া বারাশিয়া, কুমার নদ, চন্দনা প্রভৃতি এই নদীর উপনদী। নদীর শুরু থেকে কামারখালী পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে ছোট ছোট অসংখ্য নৌযান চলাচল করে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি নেই বললেই চলে।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.