‘তৃতীয় প্রতিশ্রুতি’ পূরণে এবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে নজর বিজেপির

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তাঁর সঙ্গে আলাপে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ।ফাইল ছবি : এএফপি

তত্ত্বগতভাবে বিষয়টি গুছিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগে। এবার শুরু হলো সক্রিয় পদক্ষেপ। গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে রেকর্ড জয়ের রেশ থাকতে থাকতেই ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শুরু করে দিয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রক্রিয়া।

গতকাল শুক্রবার ভারতের রাজ্যসভায় বিজেপির রাজস্থানের সদস্য কিরোরিমল মীনা এ–সংক্রান্ত ‘প্রাইভেট মেম্বার বিল (বেসরকারি বিল)’ পেশ করেছেন। বিলটি বিরোধীদের আপত্তি সত্ত্বেও কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে।

এই বিলের উদ্দেশ্য হলো দেশের বিভিন্ন ধর্ম, উপজাতি, জনজাতি, জনগোষ্ঠী, আদিবাসীদের মধ্যে বিয়ে, উত্তরাধিকার ও দত্তকসংক্রান্ত যেসব ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব আইন ও রীতি রয়েছে, তা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে এক ও অভিন্ন করে তোলা।

সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে মুসলিম ল বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। আদিবাসীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জনজাতির নিজস্ব রীতিও বাতিল হবে। জাতিগত বিভেদ উসকে দিয়ে আগামী নির্বাচনে হিন্দু ভোট টানতে বিজেপি আইনটি করতে চায় বলে মনে করছেন বিরোধীরা।

তৃতীয় প্রতিশ্রুতি পূরণ

বিলটি সংসদের দুই কক্ষে পাস হওয়ার পর সরকারিভাবে আইনে পরিণত হলে কেন্দ্রীয় সরকার তার ভিত্তিতে আইন তৈরির ক্ষমতা রাখবে। সেই আইন সারা দেশে সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে এই বিল বেসরকারিভাবে পেশ হলেও প্রয়োজন মনে করলে সরকারি সমর্থনে তা সরকারি বিলের মর্যাদা পেতে পারে। তবে তা নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভারতের পার্লামেন্ট ভবন । ছবি: এএনআই

যে তিনটি প্রতিশ্রুতি বিজেপিকে ভারতের অন্য সব দল থেকে আলাদা রেখেছিল, এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তার অন্যতম। বাকি দুই প্রতিশ্রুতির একটি ছিল জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ অধিকার দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ। অন্যটি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ‘দখলদারি হটিয়ে রাম জন্মভূমির পুনরুদ্ধার’। এ দুটি প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদির সরকার পালন করেছে। বাকি ছিল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন নিয়ে সম্প্রতি বেশ সোচ্চার হয়েছে বিজেপি। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলো সম্প্রতি এ বিষয়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে। উত্তরাখণ্ডে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে এ নিয়ে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করেছে। অবশ্য এই পাহাড়ি রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম।

একই রকমের তৎপরতার কথা শোনা গেছে উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আসাম ও গুজরাটের বিজেপি সরকারের মুখে। শুরু হয়েছে আইন প্রণয়নের চিন্তাভাবনা। হিমাচল প্রদেশের বিজেপিও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

মুসলিমদের উসকে ভোটে সুবিধা নেওয়াই যখন উদ্দেশ্য

সার্বিকভাবে বিজেপির এ তৎপরতার উদ্দেশ্য ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। প্রসঙ্গটি গতকাল রাজ্যসভার আলোচনায় এসেছিল। কিরোরিমল মীনা বিলটি পেশের অনুমতি পাওয়ার পরই ভারতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, ডিএমকের সদস্যরা বিরোধিতা শুরু করেন।

দলগুলোর অভিযোগ, বিলটি ভারতের ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ রক্ষা নীতির বিরোধী। এটি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো ধ্বংস করে দেবে। তাদের অভিযোগ, আগামী লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি এই বিলকেই বড় হাতিয়ার করতে চাইছে, যাতে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিয়ে ভোট বৈতরণি সহজে পেরোনো যায়।

নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছিল বিজেপি । ফাইল ছবি: রয়টার্স

সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে মুসলিম ল বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এতে মুসলিম সমাজ যত ক্ষুব্ধ হবে, বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের নীতির পালে ততই হাওয়া লাগবে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) মাধ্যমে একই সুবিধা নিয়েছিল বিজেপি।

বিরোধীদের অভিযোগ, শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে বিভাজনের রাজনীতির এই ব্যবহার বিজেপি বেশ হিসাব কষেই করতে চাইছে। গুজরাট ভোটের রেশ থাকতে থাকতে কালক্ষেপ না করেই বিজেপি দলীয় সদস্যকে দিয়ে এই ‘প্রাইভেট মেম্বার বিল’ পেশ করিয়েছে।

ভারতীয় সংবিধান সংসদের প্রত্যেক সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো বিল উত্থাপনের অধিকার দিয়েছে। সেই বিল কখনো কখনো সরকারি বিলের মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১৪টি বেসরকারি বিল সরকারি বিলের মর্যাদা পেয়ে আইনে পরিণত হয়েছে।

এই বিল কার্যকর হলে আদিবাসীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জনজাতির নিজস্ব রীতি বাতিল হবে। বিলটি এই সমাজকে কীভাবে ও কতটা আলোড়িত করবে, বিজেপি আপাতত তা খতিয়ে দেখছে। এ ক্ষেত্রে বিজেপি নির্ভর করছে মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) পরামর্শের ওপর। আরএসএস জনজাতি-আদিবাসীদের মধ্যে বহু বছর ধরে কাজ করছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিলটির কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়টি বিজেপিকে ভাবাচ্ছে।

বিরোধীদের একাংশ মনে করছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিজেপি চায় আইন প্রণয়নের চেয়ে এ নিয়ে হইচই বেশি হোক। যেমন হচ্ছে সিএএ-এনআরসি নিয়ে। এর পিছনের উদ্দেশ্য হলো, ভোটের আগে বিভাজন যাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.