৩৭ বছর ধরে শুধু তারিখ পড়ে চট্টগ্রাম আদালতে

প্রতীকী ছবি

মামলার রায়টি ছিল ৩৭ বছর আগের। মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড—মারধরের অপরাধে দেওয়া এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি। সেই আপিল আর নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে মারা গেছেন বাদী-আসামিও। কেউ এখন আর খোঁজ নেয় না মামলাটির।

এই মামলা হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ১৯৮২ সালের ১০ জুন উপজেলার বুড়িশ্চর এলাকায় গাছের জাম পাড়া নিয়ে মারধরের অভিযোগে মামলাটি করেন এজাহার মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিন বছর পর ১৯৮৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই মামলার রায় দেন (তখন উপজেলা আদালত ছিল)। রায়ের আদেশের বিরুদ্ধে আসামি শামসুল আলম ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। শুরু হয় আপিলের দীর্ঘ পথ। এরপর শুধু তারিখ পড়েছে ১৪২টি। কিন্তু শুনানি আর হয়নি।

চট্টগ্রামের এই মামলাটির মতো আরও ৭২টি ফৌজদারি মামলার আপিলে তারিখ পড়লেও শুনানি হয়নি। এসব আপিল ঝুলে আছে ৩০ থেকে ৩৭ বছর। এসব আপিলে তারিখ পড়েছে ১১২ থেকে ১৪২টি। এসব মামলা মারধর ও হামলার। সাজা হয়েছে এক মাস থেকে সাত বছর। কিছু ক্ষেত্রে করা হয়েছে জরিমানা।

মামলাগুলোর আপিল শুনানিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশসহ কোনো আইনি বাধা নেই। কেন এত বছর ঝুলে ছিল, তার কারণ খুঁজতে গেলে আদালত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিচারক-সংকট, মামলাজট ও নিয়মিত মামলার কার্যক্রম পরিচালনা শেষে আপিলে নজর দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ছোটখাটো অপরাধের মামলা হওয়ায় বাদী কিংবা আপিলকারী শুরুর দিকে খবর নিলেও পরে আর আসেননি।

গত জুন মাসে হাইকোর্ট দুই দশকের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার তালিকা চাইলে এই ৭৩টি আপিল ঝুলে থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা জানান, ঠিকভাবে চললে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে আপিল শুনানি করা যেত। এভাবে আপিল ঝুলে থাকায় বাদী ও আসামিদের নষ্ট হয়েছে হাজারো কর্মঘণ্টা। বাদী-আসামি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আর্থিকভাবে। কারণ, ৭৩টি মামলার সব কটি চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, পটিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার। আপিলের খোঁজ নিতে তাঁদের সেখান থেকে ছুটে আসতে হতো চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত আদালত ভবনে।

আদালত সূত্র জানায়, ফৌজদারি অপরাধে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। এরপর নিষ্পত্তির জন্য দায়রা আদালতে বণ্টন করা হয়।

এই ৭৩টি আপিল ১৯৮৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত শুনানির জন্য ছিল দ্বিতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। এরপর ২০০৩ সালে পাঠানো হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। সেখানে কোনো শুনানি হয়নি। এসব মামলা সর্বশেষ চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আসে বিশেষ দায়রা আদালতে (জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে)।

জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত নভেম্বর মাসে পাওয়া ৭৩টি মামলার আপিল শুনানির জন্য আগামী বছর তারিখ রাখা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে আদালত অবকাশকালীন বন্ধ থাকায় তারিখ পড়েনি। তিনি বলেন, এত দিন আপিলগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া দুঃখজনক। দ্রুত শেষ করার চেষ্টা রয়েছে।

শুনানির অপেক্ষা, বাদী-আসামির মৃত্যু

হাটহাজারীর ১০০ টাকা জরিমানার মামলাটি আপিল শুনানির জন্য দ্বিতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয় ১৯৮৫ সালেই। ১৭ বছরে সেখানে শুনানির জন্য ৫৮টি তারিখ পড়ে। শুরুতে আসামি উপস্থিত থাকলেও পরে পলাতক হয়ে যান। ২০০৩ সালের নভেম্বরে আপিল শুনানির জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয় মামলাটি। এতে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত তারিখ পড়ে ৮৪টি।

মামলার বাদী এজাহার মিয়ার ছেলে মো. ফোরকান বেলা অবেলাকে বলেন, রায়ের পর আসামি যখন আপিল করেছিলেন, এরপর কিছুদিন তাঁর বাবা মামলার খোঁজ নিয়েছেন। পরে আর নেননি। আর কত নেবেন। শেষ পর্যন্ত দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। আপিল দায়েরকারী আসামি শামসুল আলমও মারা গেছেন বলে জানান তিনি।

জেলার পটিয়ার আরেকটি মামলার আপিলকারীর আইনজীবী ফজলুল হকও মারা গেছেন। কিন্তু এখনো শুনানিই হয়নি সেই আপিলের। মারধরের অভিযোগে আসামি আমিনুল হককে পটিয়া সহকারী জজ আদালত তিন বছরের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা দেন ১৯৮৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। এর বিরুদ্ধে রায়ের পরপর আসামি আপিল করলে তা শুনানি না হওয়ায় তিনটি আদালত ঘুরে এটি এখন জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে এসেছে। ইতিমধ্যে মারা গেছেন বাদী আবুল কাশেম। বিভিন্ন সময় এই মামলায় তারিখ পড়েছে ১১৪ বার।

একই অবস্থা ফটিকছড়ির রোসাংগিরির মো. ইউনুসের করা মামলার। জায়গা নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁর বসতঘরে ১৯৮৫ সালের ১২ নভেম্বর হামলার ঘটনায় করা মামলায় তিন বছর পর (১৯৮৮ সাল) তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসামি নেছার আহমদকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামি ওই বছরই আপিল করেন। সেটিও ঝুলে আছে। এর মধ্যে তারিখ পড়েছে ১১২ বার।

মামলার আপিলকারীর আইনজীবী শিশির কান্তি ভট্টাচার্য বেলা অবেলাকে বলেন, এ মুহূর্তে কিছু মনে পড়ছে না। আপিলকারী অনেক বছর ধরে যোগাযোগ রাখছেন না।

সরকারি কৌঁসুলিরা যা বলেন

আপিল শুনানি কেন হয়নি জানতে মামলাগুলো পরিচালনাকারী তৎকালীন কয়েকজন সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) সঙ্গে কথা হয়। এত দিন আগের মামলা হওয়ায় তাঁদের বিষয়টি মনেও পড়ছে না। ২০০১ সাল থেকে দায়িত্বে থাকা জেলা পিপি কফিল উদ্দিন বলেন, এ রকম হওয়ার কথা নয়। এখন মনে পড়ছে না।

একই মন্তব্য করেন ১৯৯৬ সাল থেকে জেলা পিপির দায়িত্বে থাকা বর্তমানে হাইকোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ওই সময় মামলাজট বেশি ছিল। সঙ্গে ছিল বিচারক-স্বল্পতা। এসব কারণে হয়তো হয়নি।

২০০৩ সাল থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত মামলাগুলো শুনানির জন্য ছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ। সেখানে ২০০৩ সালে পিপি দায়িত্বে থাকা আবদুস সাত্তার সরোয়ার বেলা অবেলাকে বলেন, বিষয়টি তাঁর মনে নেই। পরে দায়িত্বে থাকা ফজলুল করিম ভূঁইয়া করোনায় মারা গেছেন। ১০ বছর ধরে দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম।

তিনি বেলা অবেলাকে বলেন, নারী শিশু ট্রাইব্যুনাল হওয়ার পরপরই আপিলগুলো শুনানির জন্য জেলা ও দায়রা জজ পাঠিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরে ট্রাইব্যুনাল তিনটি থেকে সাতটি হওয়ায় মামলার সংখ্যা কিছুটা কমে। এ ছাড়া আপিলগুলো শুনানির এখতিয়ার না থাকায় অন্য আদালতে সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে। এত বছর পর কেন পাঠানো হলো, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।

এত বছরেও ৭৩টি মামলার আপিল শুনানি না হওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি আইনি সহায়তা প্রদান প্রতিষ্ঠান ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম। তিনি বেলা অবেলাকে বলেন, আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের চরম অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। যে সময় চলে গেছে, তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এখন আপিলগুলো দ্রুত শুনানি করে নিষ্পত্তি করা উচিত।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.