৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও নামেই মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত স্পারসোর প্রধান কার্যালয়

২০১৮ সালের ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস কেন্দ্র থেকে দেশের প্রথম ও একমাত্র স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু–১ উৎক্ষেপণ করা হয়। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান ও রকেট প্রস্তুতকারক এবং উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স।

বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) দেশের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা হলেও এটি উৎক্ষেপণের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। মূলত, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা হতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রোগ্রাম থাকতে হয়, যা স্পারসোতে নেই। এ ছাড়া স্পারসোর মহাকাশ উৎক্ষেপণ স্টেশন, কক্ষপথ, নিজস্ব স্যাটেলাইট এবং এ–সংক্রান্ত প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাগারও নেই।

বস্তুতপক্ষে, বিদেশি অনুদানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকা সাধারণ মানের একটি গ্রাউন্ড স্টেশন (স্যাটেলাইট থেকে বার্তা গ্রহণ–সংরক্ষণ কেন্দ্র) ছাড়া দেশে মহাকাশ প্রযুক্তির অবকাঠামো নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরেও স্পারসো সত্যিকারের একটি জাতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।

যদিও স্পারসোর লক্ষ্য, মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন এবং শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা। জানা যায়, মহাকাশ প্রযুক্তি জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং দেশে মহাকাশ প্রযুক্তি বিকাশ ও ব্যবহারের লক্ষ্যে স্পারসোর উন্নয়নের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে স্পারসো এ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে দুটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন এবং দেশের উপযোগী ভূ–পর্যবেক্ষণ উপগ্রহের উন্নয়ন ও কক্ষপথে স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা। ২০২৪ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন করার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করেছিল সংস্থাটি, যা এখনো ঝুলে আছে।

এদিকে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা শুরু হয়েছে চলতি বছর থেকে। তবে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় থাকা কাজেরই কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজে হাত দেওয়ার বিষয়টি দূর অতীত। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় রয়েছে ভূ-পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উন্নয়নের লক্ষ্যে পরীক্ষাগার স্থাপন, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ টেলিস্কোপ স্থাপন, দেশের নিজস্ব দূর অনুধাবন স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন এবং মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যবহার ও প্রয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা প্রভৃতি। আর নিজস্ব প্রযুক্তিতে ভূ-পর্যবেক্ষণ উপগ্রহের উন্নয়ন ও কক্ষপথে স্থাপনসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়।

জানতে চাইলে স্পারসোর চেয়ারম্যান মো. আবদুস সামাদ বেলা অবেলাকে বলেন, ‘স্পারসোর চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা আছে। তা সত্ত্বেও চেষ্টা করছি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এবং এগিয়ে যাওয়ার।’

এর আগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন মো. জাফর উল্লাহ খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্পারসো দূর অনুধাবন নিয়ে অনেক কাজ করলেও মহাকাশ গবেষণার বিষয়টি ওইভাবে এগোয়নি। আমরা যে মহাকাশ গবেষণায় পিছিয়ে আছি, সেটাতে জোর দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিনিয়োগ প্রকল্প নিতে হবে।’

জানা যায়, স্পারসোতে বর্তমানে সরকারের কোনো প্রকল্প চলমান নেই। স্পারসোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে অটোমেটিক পিকচার ট্রান্সমিশন (এপিটি) গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে।

স্বাধীনতার পর প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, পরিবেশ, দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার বাংলাদেশ ইআরটিএস (আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট) কর্মসূচি নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় গৃহীত কর্মসূচির সফলতার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ল্যান্ডসেট প্রোগ্রাম (বিএলপি) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা কেন্দ্রকে (এসএআরসি) এবং বিএলপিকে একীভূত করে স্পারসো গঠন করা হয়। এটি ১৯৮৫ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানান্তরিত হয়।

বিজ্ঞানীর সংকট তীব্র

স্পারসোর নীতিনির্ধারণ ও পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাবান হলো স্পারসো বোর্ড। সরকারের নিয়োগ করা একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্যের সমন্বয়ে বোর্ড গঠিত। এ বোর্ডের পাঁচজনের মধ্যে চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য রয়েছেন। সংকট থাকায় যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজনই চারজন সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন।

স্পারসোর কার্যক্রম মূলত ১৬টি কারিগরি বিভাগ, পাঁচটি সহায়ক শাখা এবং সাভারে অবস্থিত একটি আঞ্চলিক দূর অনুধাবন কেন্দ্রের (আরআরএসসি) সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। পাঁচটি সহায়ক শাখার মাধ্যমে মূলত সংস্থাটির প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে। কারিগরি বিভাগের মাধ্যমে চলে গবেষণা কার্যক্রম, যার নেতৃত্বে থাকেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বা প্রকৌশলীরা।

অথচ এ কারিগরি বিভাগ ও আরআরএসসির ৬৩ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর পদের বিপরীতে মাত্র ২৩ জন কর্মরত আছেন। তাঁদের মধ্যে আবার দুজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটিতে। ফলে মূলত কাজ করছেন ২১ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। এই ২১ জনের মধ্যে ১৮ জন বিজ্ঞানী ও তিনজন প্রকৌশলী।

জানা যায়, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ৫টি পদের বিপরীতে মাত্র ৩ জন, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১১টি পদের বিপরীতে ২ জন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১৫টি পদের বিপরীতে ৯ জন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১৬টি পদের বিপরীতে ৯ জন এবং সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১৬টি পদের বিপরীতে কেউ কর্মরত নেই। স্পারসোতে মোট ১৬৯টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৯১ জন কর্মরত আছেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, জনবলসংকটের কারণে বেশির ভাগ কারিগরি বিভাগ নামমাত্র চালু আছে। কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে একাধিক বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে যিনি বন বিভাগ দেখছেন, তাঁকেই হয়তো একই সঙ্গে রকেট প্রযুক্তি বিভাগ দেখতে হচ্ছে।

বছরে গড়ে একটি করেও গবেষণা হচ্ছে না

স্পারসোর যে ১৬টি বিভাগ রয়েছে, সেগুলো হলো কৃষি, বন, পানি সম্পদ, মৎস্য, ভূতত্ত্ব, সমুদ্রবিজ্ঞান, আলোকচিত্র, মানচিত্রাঙ্কন, গ্রাউন্ড ট্রুথ, বায়ুমণ্ডল গবেষণা, মহাসাগর পদার্থবিদ্যা, অ্যাগ্রো অ্যান্ড হাইড্রোমেটিওরোলজি, যান্ত্রিক ও উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ, গ্রাউন্ড স্টেশন, মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞান ও রকেট গতিবিদ্যা ও রকেট প্রযুক্তি।

স্পারসোর কাজ এসব ক্ষেত্রে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও গবেষণা করা। জানা যায়, ২০০৮–০৯ থেকে ২০২০–২১ পর্যন্ত ১১ অর্থবছরে (এর মধ্যে দুটির তথ্য নেই) মোট ১১৭টি গবেষণা করেছে স্পারসো। মানে বছরগুলোতে গড়ে প্রায় ১১টি করে গবেষণা হয়েছে। অর্থাৎ, সব বিভাগ বছরে গড়ে একটি করেও গবেষণা করেনি। জানা গেছে, বিজ্ঞানী–সংকটের কারণে রকেট প্রযুক্তি উন্নয়ন, মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞান ও রকেট গতিবিদ্যা, সমুদ্রবিজ্ঞান, গ্রাউন্ড স্টেশন, মানচিত্রাঙ্কন, আলোকচিত্রসহ বেশ কিছু বিভাগ গবেষণায় পিছিয়ে আছে।

স্পারসো গবেষণা ও প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠান হলেও প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পর ২০১০ সালে প্রথম গবেষণার জন্য তহবিল দেওয়া শুরু করে সরকার বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তাঁর মতে, গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার আগে স্পারসোর বিজ্ঞানীরা স্বতন্ত্রভাবে কিংবা কোনো প্রকল্পের আওতায় গবেষণা করতেন। প্রথম দিকে গবেষণার জন্য বরাদ্দ অল্প থাকত, দিন দিন তা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বরাদ্দ বাড়লেও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার সংকটের কারণে তা ভালোভাবে গবেষণায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি। এশিয়া প্যাসিফিক স্পেস কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এপিএসসিও) সদস্যদেশ হওয়ায় সংগঠনটির কাছ থেকে অনুদান হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে একটি সাধারণ মানের জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। বর্তমানে সেটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে চালু হয়েছে।

এটিই বর্তমানে দেশের একমাত্র গ্রাউন্ড স্টেশন, যার মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে বার্তা গ্রহণ ও সংরক্ষণ করা হয়। তাহলে স্পারসোর বিজ্ঞানীরা কীভাবে গবেষণা করেন, জানতে চাইলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পর্যায়ের একজন বলেন, অন্য দেশের স্যাটেলাইটের ডেটা ব্যবহার করা হয়। কখনো কিনে, কখনো বিনা পয়সায় বিদেশি স্যাটেলাইট থেকে ডেটা নেওয়া হয় গবেষণার জন্য।

শেষ দশকে উপকূলে ভূমি বিলীন বেশি হয়েছে

স্পারসোর বিভাগগুলোয় মহাকাশ ও দূর অনুধাবন—এ দুটি বিষয়ে গবেষণা হয়ে থাকে। এর মধ্যে মহাকাশ নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের অল্প কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। তবে দূর অনুধাবন নিয়ে গবেষণা হয়েছে বেশি। দূর অনুধাবন বিষয়ে ২০২০–২১ অর্থবছরে যেসব গবেষণা হয়েছে, তার একটি হলো ‘আইডেন্টিফিকেশন অব দ্য পটেনশিয়াল লোকেশনস ফর রিক্লেমেশন অব ল্যান্ডস ইন দ্য মেঘনা এসচুয়ারি অব বাংলাদেশ ইউজিং রিমোট সেন্সিং টেকনিক’।

মেঘনা মোহনার ৯ লাখ হেক্টরের বেশি অঞ্চল নিয়ে করা এ গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে মেঘনার মোহনায় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর পরিমাণ চর জেগেছে। একই সময়ে মেঘনার দুই পাড় এবং মোহনায় ও সাগরের চরের ৬৩ হাজার হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হয়েছে।

চলতি বছরের মাঝামাঝি শেষ হওয়া ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব আ জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম অব দ্য কোস্টাল এরিয়াস অব বাংলাদেশ অ্যান্ড অন রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএস টেকনিক’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পুরো উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে উপকূলজুড়ে ভূমি বিলীন হয়ে যাওয়া ও নতুন ভূমি জাগা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে গত দশকে (২০১০–২০২০) উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি বিলীন হয়েছে বেশি এবং নতুন ভূমি জেগেছে কম।

কাজ নেই সাভারের দূর অনুধাবন কেন্দ্রের

ঢাকার অদূরে সাভারে পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ৮ একর জমিতে ১৯৮৫ সালে স্পারসোর আঞ্চলিক দূর অনুধাবন কেন্দ্র স্থাপিত (আরআরএসসি) হয়। কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, ফ্রান্স সরকারের ঋণে সেখানে গ্রাউন্ড স্টেশন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা পুরোদমে কার্যক্রমে যেতে পারেনি। তার আগেই ফ্রান্স সরকার সহায়তা বন্ধ করে দেয়।

কয়েক বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর বন্ধ হয়ে যায় আরআরএসসি। স্পারসোর আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকবে এবং এটা প্রয়োজনবোধে সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে দেশের যেকোনো স্থানে শাখা কার্যালয়, গবেষণা কার্যালয় ও গবেষণাগার স্থাপন করতে পারবে। অথচ ১৯৮৫ সালে সাভারে আরআরএসসি স্থাপন ছাড়া স্পারসোকে সম্প্রসারণের আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

কৃষিতে পড়ে মহাকাশ গবেষণার চেয়ারম্যান

স্পারসোর বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুস সামাদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে স্নাতক এবং চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্পারসোর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করলেও মহাকাশ বিষয়ে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের পঞ্চদশ ব্যাচে যোগদান করে পর্যটন করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করার পর পদোন্নতি পেয়ে স্পারসোতে এসেছেন।

এ ছাড়া ৪২ বছরে স্পারসোতে ২৫ জন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ২৬তম চেয়ারম্যান দায়িত্বে আছেন। অর্থাৎ, একেকজন চেয়ারম্যান গড়ে দেড় বছরের কিছু বেশি সময় করে দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, স্পারসোর চেয়ারম্যান হিসেবে বিসিএস ক্যাডারদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্পারসোতে আগে এমনও চেয়ারম্যান যোগ দিয়েছেন, যাঁরা সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসনে লেখাপড়া করেছেন। প্রশাসন ক্যাডার থেকে তাঁরা আসায় মহাকাশ বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান থাকে না। এখানে এসে তাঁরা শেখেন। শিখতে শিখতে আবার তাঁদের অন্য দপ্তরে বা অবসরে চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়।

মহাকাশ অর্থনীতিতে দেশের অনুপস্থিতি

টেলিভিশন দেখা, স্মার্টফোনের ব্যবহার কিংবা অনলাইনে বিভিন্ন বিল প্রদানসহ নানা কাজে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন শতকোটি মানুষ জেনে বা না–জেনে স্যাটেলাইট সেবা নিচ্ছে বলে জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্যাটেলাইট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (এসআইএ)। তাদের তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ৫৮৫টি করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়েছে।

২০২২ সালের শুরুতে কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারের ওপরে। ২০২১ সালে প্রকাশিত এসআইএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতির আকার ৩৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। সামনের দিনগুলোতে মহাকাশ অর্থনীতি আরও বড় ও শক্তিশালী হবে।

অথচ বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবদান নেই বললেই চলে। স্পারসো ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতির সঙ্গে কেবল সম্পৃক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সত্যিকারের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা হয়ে ওঠার জন্য স্পারসো যে পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়নে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। স্পারসোর মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণার অবকাঠামো গড়ে উঠলে এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরি হবে। এরপর বেসরকারি খাত মহাকাশ অর্থনীতিতে বিনিয়োগে এলে এ–সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করে স্পারসো নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা পালন করতে পারে।

স্পারসোর সাবেক চেয়ারম্যান মো. জাফর উল্লাহ খান বলেন, অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশ অর্থনীতির যে বিশাল আকার দাঁড়াবে, তার ন্যূনতম অংশ ধরতে চাইলে প্রথম দিকের বিনিয়োগগুলো সরকারকে করতে হবে। পরে নীতিমালা করে দিতে হবে। তারপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে এ শিল্প বিকশিত হবে।

কর্মকর্তারা বলছেন, স্যাটেলাইট সেবা বিক্রি ছাড়াও সরকার নানাভাবে উপকৃত হতে পারে। স্পারসোর আরেক সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নূর হোছাইন শরীফি ‘বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তির সম্ভাবনা’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মহাকাশ কর্মসূচিতে এক ডলার বিনিয়োগ করে আট ডলারের অর্থনৈতিক সুবিধা পায়।

স্পারসোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্পারসোর দাঁড়ানোর জন্য পরিবেশ নেই। এটা যে বৈজ্ঞানিক সংস্থা, এটা সরকার হয়তো বোঝে না বা ইচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে একে বিকশিত করার চেষ্টা করলে দাঁড়াবে, নাহলে এমনই থাকবে।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.