শীতের প্রকোপ তেঁতুলিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও শ্রীমঙ্গলে এত বেশি কেন

শীত থেকে বাঁচতে আগুন পোহাচ্ছে দরিদ্র মানুষ । ফাইল ছবি

দেশের তিন ভৌগোলিক অবস্থানে থাকা তিনটি এলাকা হলো পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং চুয়াডাঙ্গা। তেঁতুলিয়া দেশের সর্বোত্তরের জনপদ, দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা চুয়াডাঙ্গা আর উত্তর-পূর্বের এলাকা শ্রীমঙ্গল। ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও এ তিন এলাকার এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। এই তিন জনপদে সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে।

গতকাল রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি এ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। শীত মৌসুমের শুরুতে একনাগাড়ে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায়।

গত ৩০ বছরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায়। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সে বছর তাপমাত্রা ছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শ্রীমঙ্গলে গত সপ্তাহে একাধিকবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। প্রতি বছরই এমন থাকে। কিন্তু তিন দিকে অবস্থিত এলাকাগুলো কীভাবে বেশি শীতে কাঁপে?

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, ভূপ্রাকৃতিক কিছু কারণেই এ ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিকে বুক উঁচিয়ে থাকা হিমালয় পর্বতমালা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রকৃতির নানা ধারা নিয়ন্ত্রণে হিমালয় পর্বতের ভূমিকা আছে বলে মত দেন আবহাওয়াবিদ ও ভূতত্ত্ববিদেরা।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, হিমালয় না থাকলে সব আর্দ্রতা উত্তর দিকে চলে যেত। গরমের দিনে বৃষ্টি হতো না, আবার একই সঙ্গে ঠান্ডার দিনে উত্তুরে (বা ইউরোপের) তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হাওয়া চলে আসত। হিমালয় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এটি উত্তুরে তীব্র ঠান্ডা আসতে দেয় না আবার আর্দ্রতাকেও যেতে দেয় না। এ জন্য বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে এবং শীতল হাওয়া বাধা পাচ্ছে।

উচ্চ বায়ুমণ্ডলের বিন্যাসটাই এখানে বিচার্য বিষয় বলে মনে করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার। তিনি বলেন, ‘শীত ও গ্রীষ্ম উভয়েই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে, অর্থাৎ ভারতের কাশ্মীর, দিল্লি—এসব এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসে।’

তবে উত্তর গোলার্ধ থেকে আসা শীত বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলে সোজা হয়ে ঢুকতে পারে না বলে মন্তব্য করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, হিমালয় থেকে আসা বায়ুর একটি অংশ কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের একাংশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গরমের দিনে দিল্লির তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসতে থাকে। আবার শীতকালে দিল্লির অতি শীত ধীরে ধীরে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসে। শীতের সময় এই উত্তুরে হাওয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ঢোকে।

বজলুর রশিদ আরও বলেন, হিমালয়ে বাধা পাওয়া আরেকটি হাওয়ার দল মিয়ানমার ও উত্তর–পূর্ব ভারতের একটি চ্যানেল দিয়ে শ্রীমঙ্গল হয়ে প্রবেশ করে। এই অঞ্চল এমনিতেই উঁচু। জলাভূমিও কম। তাই শীত বেশি। আর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার শীতের কারণ হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থান বলে মনে করেন বজলুর রশিদ।

কাছাকাছি অন্য জনপদ থাকলেও এই হাওয়া কেন শ্রীমঙ্গলে বেশি করে বাসা বাঁধে, তার কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা। তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গল অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চল। আর উঁচু স্থানে স্বভাবতই তাপমাত্রা কম থাকে।

অধ্যাপক আনোয়ার উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের ব্যাখ্যা, হিমালয়ের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল, তেঁতুলিয়া এবং চুয়াডাঙ্গা ও যশোর এলাকার কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেন। সেগুলো হলো, তিনটি এলাকায় জলাশয় অপেক্ষাকৃত কম। এখানে তাই শীতের আধিক্য হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। আবার সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে তিন এলাকার মাটির তাপ ধারণ কম। সে জন্যই এসব এলাকায় শীতের আধিক্য।

শীতে গরম কাপড় পরিয়ে সন্তানকে নিয়ে বেরিয়েছেন বাবা
শীতে গরম কাপড় পরিয়ে সন্তানকে নিয়ে বেরিয়েছেন বাবা

আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা বলেন, ‘জলাশয় আধিক্য অঞ্চলে তাপমাত্রা ধারণ করে রাখে এসব জলাশয়। শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি সিলেট হলেও সেখানে জলাশয়ের আধিক্যের কারণে শীত সাধারণত কম হয়। আবার চুয়াডাঙ্গার কাছাকাছি হলেও খুলনায় জলাশয় বেশি বলে সেখানে তাপমাত্রা বেশি আবার যশোরে কম থাকার কারণে সেখানে প্রায় চুয়াডাঙ্গার মতোই শীত পড়তে দেখা যায়।’ এসব ব্যাখ্যা দিয়ে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, যেসব কারণের কথা বলা হলো, সেগুলো নিয়ে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজন।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘এসব ঘটনা ঘটছে প্রাকৃতিকভাবেই। প্রকৃতির উপর তো কারও কোনো হাত নেই।’

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.