ফাঁকা মাঠে লিটন, তবে ঘরের ভেতর আগুন

ছবি: সংগৃহীত

দলীয়ভাবে সিটির ভোটে না থাকার সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি। ফলে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সামনে নেই শক্ত কোনো দেয়াল। ভোটের মাঠে প্রবল প্রতিপক্ষের ছায়া না থাকায় অনেকের ধারণা, এবার লিটন জিতবেন হেসেখেলেই। তবে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও নগরীতে আওয়ামী লীগের ঘরোয়া বিবাদ স্বস্তি দিচ্ছে না নৌকার প্রার্থীকে। দ্বন্দ্ব আর মনোমালিন্যে অনেক নেতার অন্তরে জ্বলছে ছাইচাপা আগুন। নগর ও জেলা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এমন তথ্য।

দু’মাস আগের ডাবলুকাণ্ড
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের নামে দু’মাস আগে একটি অশ্লীল ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি নকল ও উদ্দেশ্যমূলক ছড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে ডাবলু সে সময় থানায় মামলাও করেন। এ ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে ডাবলুকে পদ থেকে সরাতে সে সময় প্রতিদিন নগরীতে কর্মসূচি পালন করেন লিটনের অনুসারী নেতাকর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে ডাবলু ঢাকায় দলীয় প্রধানের কাছে মৌখিকভাবে লিটনের নামে নালিশও করেন। এ ঘটনার পথ ধরে সিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোমালিন্য প্রকাশ্যে আসে।

ডাবলুর ঘনিষ্ঠজন মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, লিটন প্রার্থী হলে নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ডাবলু সরকারের ছিল না। ভিডিও নিয়ে নোংরামি শুরু হলে দলের অভিভাবক হিসেবে লিটন সমাধানের কোনো চেষ্টা করেননি। উল্টো তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা ভিডিও নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। এর পর তাঁরাই আবার ডাবলুর শাস্তি দাবিতে রাস্তায় নামেন। অথচ প্রায় একই সময়ে আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, এমন এক সংসদ সদস্যকে দিয়ে খায়রুজ্জামান লিটন তাঁর দলীয় মনোনয়ন তুলেছেন। ফলে বোঝা যায়, তিনি কার পক্ষ নিচ্ছেন। সেই ক্ষোভ থেকেই প্রকৃতপক্ষে ডাবলু দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আবার একই কারণে গত ৭ মে লিটনের নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা থেকে ডাবলু সরকারকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তবে এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই বলে দাবি করেন খায়রুজ্জামান লিটন। গত ২৪ এপ্রিল নগরীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘সে (ডাবলু) যা করেছে, তাতে তাকে নিয়ে মানুষের সামনে যাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাকে নিয়ে ভোট চাইতে যাব কীভাবে?’

লিটনের ঘরেই দুই পক্ষ
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লিটন পরিবারের ঘনিষ্ঠদের মধ্যেই এখন দুটি পক্ষ। এক পক্ষে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, তাঁর ভাই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শফিকুজ্জামান শফিক, নগর আওয়ামী লীগের দুই যুগ্ম সম্পাদক নাইমুল হুদা রানা ও মোস্তাক হোসেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুল মোমিনসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বড় একটি অংশ। অন্য পক্ষে রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু, নগর আওয়ামী লীগের সদস্য শামসুজ্জামান আওয়াল, নগর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনি, সাংগঠনিক সম্পাদক মুকুল শেখসহ তাঁদের অনুসারীরা। দুই পক্ষ নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে কাজ করলেও নানা পরিসরে একে অপরকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান দলটির নেতাকর্মীরা।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমরা এখানে নৌকার প্রার্থীর জন্য কাজ করছি। কে কী করল, না করল, তা দেখার বিষয় না।’

নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু দাবি করেন, খায়রুজ্জামান লিটনের নির্দেশের বাইরে তাঁরা এক  চুলও নড়েন না। যারা বিরোধিতা করে, তারা দলের ভালো চায় না বলেই বিরোধিতা করে।
এদিকে খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দল দুটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুর বিপক্ষে সামান্য ভোটে জেতেন বাদশা। সেই নির্বাচনে লিটনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাদশার সমর্থকরা। সেই থেকে রাজশাহীর শীর্ষ এ দুই নেতার মধ্যকার সম্পর্ক তেতো।
যদিও গত ২ মে সন্ধ্যায় নগরীর রাণীবাজারে লিটনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের সভায় দুই নেতাই যোগ দেন। সভা শেষে বেরিয়ে ফজলে হোসেন বাদশা সাংবাদিকদের জানান, খায়রুজ্জামান লিটনই ১৪ দলের মেয়র প্রার্থী। তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচনে কাজ করবেন। আর খায়রুজ্জামান লিটন জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও ১৪ দল একসঙ্গে থাকবে।

লিটনের বক্তব্যে অনেকের বিস্ময়
গত ২৪ এপ্রিল সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে সিটি নির্বাচন বিষয়ে মতবিনিময় করতে গিয়ে খায়রুজ্জামান লিটনের দেওয়া বক্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। ওই অনুষ্ঠানে মেয়র লিটন জেলার একাধিক দলীয় এমপিকে নিয়ে করেন বিরূপ মন্তব্য। এক এমপির ‘এখনও নাক দিয়ে পোঁটা (সর্দি) পড়ে’ বলে উল্লেখ করেন। আরেকজনের ব্যাপারে বলেন, তিনি তাঁর নানিশাশুড়ির এলাকায় ভোট করেন। তাঁর এমন বক্তব্য নিয়ে ওইসব এলাকার এমপির অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সে অনুষ্ঠানে কয়েকজন এমপি ও দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলে লিটন বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র করে লাভ নেই। আমি যতক্ষণ ভুল না করছি; আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে ফেলে দিতে পারবে না।’ নির্বাচনের আগে লিটনের এমন বক্তব্য ও আচরণ দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে আরও উস্কে দিয়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা দাবি করেন, নির্বাচনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জিতে যাবেন– এমন আত্মবিশ্বাস রয়েছে লিটনের। এ কারণে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের সুযোগ নিতে চাইছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ২০২১ সালে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার পর স্থানীয় রাজনীতির নাটাই নিজের হাতে রাখতে চান লিটন। মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেলে জাতীয় নির্বাচনে তিনি তাঁর পছন্দ-অপছন্দ প্রয়োগ করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সব সময় নৌকার প্রার্থীর জন্য কাজ করি। এবারও করব। কেউ কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় দলের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করছেন। তাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’ আয়েন দাবি করেন, বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে যাঁরা কাজ করেছেন, সেইসব বিদ্রোহীকে এক জায়গায় করে একটি বলয় তৈরি করা হয়েছে। এরাই কুৎসা রটানোর কাজ করছে।

রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বক্তব্য জানতে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান আজাদ বলেন, ‘গত মার্চে শেষ হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ। ২০২০ সালে যখন এই কমিটি গঠিত হয়, তখন সভাপতি ছিলেন খায়রুজ্জামান লিটন। ২০২১ সালে তাঁকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করার পর ওই পদ ছেড়ে দিতে হয়। এর পর কমিটির নিয়ন্ত্রণ ছিল সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের হাতে। এখন বিভিন্ন কারণে ডাবলু সরকারকে নিয়ে তাঁর (লিটনের) বিরূপ মনোভাব থাকতে পারে। হয়তো এ কারণে তাঁকে দূরে দূরে রাখছেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র থেকে একটি নির্দেশনা দিলে আমরা কাজ করে শান্তি পেতাম।

দ্বন্দ্বের প্রভাব নির্বাচনী প্রচারণায়
মূল দল থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিরোধ আরও খোলাসা হয়েছে রাসিক নির্বাচনের আগাম প্রচারণায়। ডাবলু সরকার ও তাঁর অনুসারীদের বাদ রেখেই রাসিক নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগকে দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ডাবলু সরকার মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। বিষয়টি নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠানে মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন প্রকাশ্যে ডাবলুর সমালোচনা করেন।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অভ্যন্তরীণ বিরোধ সিটি নির্বাচনে তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ কোন্দল প্রকট হতে পারে।

গত ২৫ এপ্রিল মহানগর যুবলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দিয়ে যুবলীগের ব্যানারে রাসিক নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় ও ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনি ও সাংগঠনিক সম্পাদক মুকুল শেখ। নগর যুবলীগের মূল কমিটির বড় অংশই সেখানে ছিল না।

এ ব্যাপারে মহানগর যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক ইতু হাসান বলেন, ‘সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দিয়ে গুটিকয়েক যুবলীগ নেতার নামে অনুষ্ঠান করে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা লিটন ভাইকে দেখতে হবে।’
এ ব্যাপারে তৌরিদ আল মাসুদ রনি দাবি করেন, মহানগর যুবলীগ নেতারা নির্বাচনে খুব একটা ভূমিকা পালন না করায় তিনি আলাদা কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর এই কর্মসূচি ব্যক্তিগত উদ্যোগে হওয়ায় কোনো সমস্যা তৈরি হওয়ার কথা না। যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁরাই বিপক্ষে কথা বলছেন। তবে এ ঘটনার পর লিটন যুবলীগের সবাইকে নিয়েই মতবিনিময় করেন। সেখানে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার তাগিদ দেন।

এদিকে যুবলীগের মতোই তৌরিদ আল মাসুদ রনির বিরুদ্ধে সাবেক ছাত্রলীগ ফোরামের মধ্যে বিভক্তি তৈরির অভিযোগ ওঠে। গত ২৮ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বেই পদ্মার পাড়ের একটি রেস্তোরাঁয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে নিয়ে আগাম নির্বাচনী সভার আয়োজন করা হয়।

বিরোধ প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘নির্বাচনে সব কার্যক্রমে আমিসহ মহানগরের অনেক নেতাকর্মীকে মাইনাস করা হয়েছে। তবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় আমরা তাঁর পক্ষেই কাজ করছি। আমি মনোনয়নপত্র তুলেছিলাম। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব না।’
রুয়েট মিলনায়তনে গত ২৮ এপ্রিল ছাত্রলীগের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে খায়রুজ্জামান লিটনকে বিভাজন বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা কোনো বিভাজন চাই না। দ্রুত সমস্যা নিরসন করা হবে। সে জন্যই কেন্দ্রীয় নেতারা চেষ্টা করছেন।’ তিনি দাবি করেন, বিভাজন সৃষ্টিকারীরা দলের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। তাই এটিকে দলের মধ্যে সেই অর্থে বিভাজন বলা যায় না।

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.