বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ‘ফুটবল’

শৈশব পেরিয়ে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েদের হঠাৎ করে একে একে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। যে বয়সে মেয়েদের লেখাপড়া ও হাসিখেলায় মেতে থাকার কথা, সেই বয়সে তাদের সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছিল। নিজের ছাত্রীদের এমন করুণ পরিণতি দেখে কেঁদে ওঠে স্কুলশিক্ষিকা কামরুন্নাহার মুন্নির হৃদয়।

এমন পরিস্থিতি থেকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন কামরুন্নাহার। বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কৌশল হিসেবে তিনি ছাত্রীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক মেয়ের জীবনের গতিপথে পরিবর্তন এনেছেন তিনি।

বাল্যবিবাহ থেকে মেয়েদের রক্ষা করতে কেন বেছে নিলেন ফুটবল খেলা, কীভাবে গড়ে তুললেন, ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস অ্যাকাডেমি’। সেসবের গল্পই শোনালেন কামরুন্নাহার মুন্নি। ২০১০ সালে কামরুন্নাহার টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা খেলাধুলার আয়োজন করতেন। ২০১২ সালে টাঙ্গাইল প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণে আসেন কামরুন্নাহার। প্রশিক্ষণ শেষে স্কুলে ফিরে গিয়ে দেখেন অনেক মেয়েই নেই। তাদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। কিছুদিন পর বাল্যবিবাহের শিকার এক ছাত্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়। তার কাছে শুনতে পান বাল্যবিবাহের ঘটনা। তখন কামরুন্নাহার সিদ্ধান্ত নেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে মেয়েদের বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করা যায়।

২০১৪ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়।

সে সময় বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল গঠন করা হয়। কামরুন্নাহারও তাঁর স্কুলে ফুটবল দল গঠন করেন। কামরুন্নাহার বলেন, ‘একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, যাঁরা বাল্যবিবাহ করেন, সেসব পুরুষ একটু সংকীর্ণ মনের হয়। যে মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলে, চুল ছোট করে কেটে রাখে, তাদের বিয়ে করতে উৎসাহিত হন না সেসব পুরুষ। তখন মনে হলো, ফুটবল খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে মেয়েরা বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাবে। তাই মেয়েদের ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত করতে থাকি।’

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইল শহরের উত্তরণ শিশু শিক্ষালয়ে বদলি হয়ে আসেন কামরুন্নাহার। এরপর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দল গঠনসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পান তিনি। এ সময় গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত করেন। কিন্তু দেখা যায়, অনেক পরিবার মেয়েদের খেলাধুলায় থাকতে দিতে চায় না। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নিয়মিত টাঙ্গাইলে এসে অনুশীলনে অংশ নিতে পারে না। সেই মেয়েদের নিজের বাসায় রেখে অনুশীলন করার ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস একাডেমি’ গঠন করেন। এই একাডেমিতে মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন ৩৫ জন মেয়ের প্রশিক্ষণ চলছে। তাদের সবার থাকা-খাওয়া, অনুশীলন—সব ব্যবস্থা করেন কামরুন্নাহার। শুরুর দিকে নিজের আয়ের জমানো টাকা খরচ করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। পরে কামরুন্নাহার ‘ডেইলি স্টার আনসাং ওমেন্স নেশন বিল্ডার্স’ পুরস্কার লাভ করেন। সেই পুরস্কারের দুই লাখ টাকার পুরোটাই তিনি খরচ করেছেন এই একাডেমিতে। তাঁর স্বামী আনোয়ার সাদাত উজ্জ্বল ও টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মির্জা মাসুদ তাঁকে সহযোগিতা করেন।

এ পর্যন্ত ৩৮ জন মেয়েকে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করেছেন কামরুন্নাহার। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভূঞাপুরের মেয়ে মিলিকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মিলিকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে শুনে তার অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তাঁদের বুঝিয়ে মিলিকে নিয়ে আসেন নিজের একাডেমিতে। কিছুদিন পর শোনেন, বিয়ে ভেঙে গেছে। কামরুন্নাহার বলেন, ‘মিলির মাথায় ছিল লম্বা চুল, দেখতেও সুন্দর ছিল। আমি ওকে বলি, বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে ফেলতে। বিয়ে ভাঙতে মিলিও তার চুল কেটে ফেলেছিল। সেই মিলি পরে বিকেএসপিতে প্রমীলা ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছিল।’

কামরুন্নাহার আজ একজন সফল কোচ। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) বি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছেন। এর আগে ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স করেছেন। বিকেএসপিতেও করেছেন কোচেস কোর্স। কামরুন্নাহারের একাডেমির মেয়েদের নিয়ে গড়া টাঙ্গাইল জেলা দল ২০২১ সালে এবং ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে আনসারের হয়ে খেলেছেন অ্যাকাডেমির ফুটবলার সিরাত সাবরিন ও রূপা আক্তার। বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্যজয়ী রাগবি দলের সবাই এই একাডেমির। বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আট নারী ক্যাডেট ফুটবলার। এ ছাড়া বিকেএসপির স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত ২৫ জন।

৩৬ বছর বয়সী কামরুন্নাহার নিঃসন্তান। অ্যাকাডেমির মেয়েরাই যেন তাঁর আদরের সন্তান। মেয়েদের নিয়েই তাঁর সব ভাবনা। কামরুন্নাহার বলেন, ‘মেয়েরা খেলতে চায়। কিন্তু অনেক পরিবার মেয়েদের খেলতে দিতে চায় না। আমি মনে করি, খেলার মাধ্যমেই বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব। খেলায় যুক্ত হলে মেয়েদের মধ্যে নেতৃত্ববোধ তৈরি হয়, দূর হয় সংকীর্ণতা।’

কামরুন্নাহার মুন্নিকে নিয়েই তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাণিজ্যিক শাখায় ‘মার্সে দ্যু ফিল্ম’-এ নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটির কারণে কামরুন্নাহারের বাল্যবিবাহ ঠেকানোর সংগ্রামের কথা আজ শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের কাছে।

কামরুন্নাহার বলেন, ‘প্রথম যখন মেয়েদের নিয়ে ফুটবল অনুশীলন শুরু করি, তখন অনেকেই বলতেন, এটা আমার পাগলামি। ধীরে ধীরে সফলতা আসছে। এখন অনেকেই এটাকে আর পাগলামি মনে করে না। আমি চাই, কোনো মেয়ের শিক্ষাজীবন যেন ঝরে না যায়। কাউকে যেন বাল্যবিবাহের শিকার হতে না হয়।’

Sign up for the Newsletter

Join our newsletter and get updates in your inbox. We won’t spam you and we respect your privacy.