পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দিতে হবে: মেনন
‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ।
২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি নেই। উপযুক্ত সময়ের মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য পাহাড়-সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিদের সমন্বয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে রাশেদ খান মেনন এসব কথা বলেন। পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে বৃহত্তর সম্মিলিত গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের বিভিন্ন দল-সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ে নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ এ সমাবেশের আয়োজন করে। নবগঠিত এ প্ল্যাটফর্মের প্রথম এ কর্মসূচিতে মেনন সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে পাহাড়ে দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান হয়। বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এ চুক্তি করে। গত ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পূর্ণ হলো। সরকার ৭২ ধারাসংবলিত চুক্তির বড় অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করলেও পিসিজেএসএসের দাবি, ভূমি ও আইন–শৃঙ্খলাসহ চুক্তির মূল বিষয়গুলোরই এখনো সুরাহা হয়নি। এ চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি নিয়েই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ গঠিত হয়েছে। আর এবারই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে মূলধারা কিছু রাজনৈতিক দলও একত্রে সমাবেশ করল।
সমাবেশের আয়োজকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক করা এবং স্থানীয় শাসন নিশ্চিতে চুক্তি মোতাবেক পরিষদের যথাযথ ক্ষমতায়ন; পার্বত্য ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করে তাঁদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং দেশের মূল স্রোতোধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা। এসব দাবি আদায়ে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন আয়োজকেরা।
সমাবেশে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ক্ষুণ্ন হলে শুধু বাংলাদেশের শান্তি ক্ষুণ্ন হয় না, বাংলাদেশকে তা অনিরাপদ করে তোলে। কেননা, পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে বিস্তৃত। সেখানে শান্তি বজায় না থাকলে তার ফলাফল কী হতে পারে, তা এখন আমরা দেখছি। বিশেষ কায়দায় সেখানে যেসব সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করা হয়েছে, তারা আজকে দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।’
পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হলেও এখনো তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করে মেনন বলেন, ‘এ চুক্তির ফলে সেদিন অস্ত্র সমর্পণ করা হয়েছিল এবং শান্তি বাহিনী নামে পরিচিত ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এ চুক্তির কারণে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) নিজে ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি নেই। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, পার্বত্য অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সেখানকার জনমিতি পাল্টে গেছে।
বাঙালিরা সেখানে সংখ্যাধিক্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। পার্বত্য অঞ্চলে এই যে পরিবর্তন সাধিত হলো, এটা পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। পার্বত্য অঞ্চলে অভিবাসনের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়ার ফলে আজকে সেখানে পার্বত্যবাসীরাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে।’
সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, পাহাড়িদের লড়াইটা কেবল পাহাড়িদের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই নয়, এর সঙ্গে দেশের মূলধারার আন্দোলনকে সম্পৃক্ত করা না গেলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের স্বাদ বাংলার প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সেখানে একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে। সেখানে ঔপনিবেশিক কায়দায় মানুষের ওপর শাসন-শোষণ অব্যাহত আছে। এগুলো সেখানে এখনো দৈনন্দিন ব্যাপার।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হলে তাতে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, ‘যে সরকার ২৫ বছর আগে শান্তিচুক্তি করলেন, সেই চুক্তি তারা কেন বাস্তবায়ন করলেন না? সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে অনেক রাজনৈতিক দলকে সমবেত করা দরকার। এ ইস্যুতে আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের স্বপ্ন দেখছি।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে থাকা দলগুলোই এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। এটি নিয়ে আন্দোলন হলে সংসদীয় ককাসের একটি প্রতিনিধিদল এ আন্দোলনে অংশীদার হিসেবে রাজপথে ভূমিকা রাখবে। এতে বোঝা যাবে, যে সংসদ নিয়ে এত বিতর্ক চলছে, সেই সংসদে ঐকমত্য নেই, শান্তিচুক্তির পক্ষের মানুষও সংসদে আছেন।’
সমাবেশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পরও তা বাস্তবায়নের দাবিতে সমাবেশ করতে হচ্ছে। যাঁরা চুক্তি করেছিলেন, তাঁরা এখনো ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো রেখা দেখা যাচ্ছে না।
পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দাবি করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে আমরা অনেকেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফসল মনে করেছিলাম। এর মূল বিষয় ছিল—শান্তি ফিরিয়ে আনা ও স্বীকৃতি দেওয়া। আজকে ২৫ বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে অনুমতি নিতে হচ্ছে! এটা স্পষ্ট যে ওই চুক্তির যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি।’
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অন্যদের মধ্যে প্ল্যাটফর্মের আরেক যুগ্ম সমন্বয়কারী খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, আদিবাসী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলীক মৃ, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল, ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি অতুলন দাস প্রমুখ বক্তব্য দেন।